শ্রম বলতে কায়িক পরিশ্রমকে বুঝায়। মানসিক পরিশ্রম অনেক পরে শ্রম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। হযরত আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়া (আঃ) এর পৃথিবীতে আগমনের অর্থাৎ পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টির পর থেকেই শারীরীক বা কায়িক পরিশ্রমের সৃষ্টি হয়েছে। বেঁচে থাকার জন্য নিরাপদ স্থান খুঁজে নেওয়া, আহার সংগ্রহ ইত্যাদি কাজ তখন থেকে শুরু এবং ক্রমে ক্রমে তার প্রসার ঘটে। প্রথমদিকে ছেলে মেয়ে সবাই একত্রে কায়িক পরিশ্রম করে জীবনধারণ করত। কিন্তু গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসবের সময় মেয়েরা কাজ করত না। তখন পুরুষ সঙ্গীটি তার কাজগুলো করে দিত।
সৃষ্টির আদিকাল থেকে অর্থাৎ পুরাতন প্রস্তর যুগ থেকে আমরা দেখতে পায় প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করে এবং কায়িক পরিশ্রম করে জীবনে বাঁচার লড়াই। প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সব মানুষের শারীরীক সামর্থ্য যে একইরকম ছিল তা নয়। স্বাস্থ ও শক্তিতে কম-বেশী সব সময় ছিলো। কিন্তু সৃষ্টির আদিকাল থেকেই হিংস্র জীব-জন্তুর আক্রমণ ও প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে বেঁচে থাকা, নিরাপদ আশ্রয় খোঁজা এবং আহার সংগ্রহের জন্য সবাই একে-অন্যকে সাহায্য করত।
কিন্তু বুদ্ধিমত্তায় সেরা এই মানুষ প্রজাতির নিয়ন্ত্রণে প্রকৃতি যত বেশী অধীনে আসতে শুরু করল তত বেশী তাদের মধ্যে ভোগ, আরাম-আয়েশের চিন্তা মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠতে লাগল। নিরন্তর পরিশ্রমের তখন প্রয়োজন অনেক কমে যেতে লাগল। এই সময়ই শারীরিকভাবে শক্তিধর ও বুদ্ধিমান একজন মানুষ তার চাইতে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও কম বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে দিয়ে কায়িক পরিশ্রম করে সম্পদ ও ভোগসামগ্রী সংগ্রহে বাধ্য করল এবং নিজে তা শুধু ভোগ করতে শুরু করল। এইভাবেই শুরু হয় সামাজিক বিভাজন – সবল ও দূর্বল শ্রেণী। দূর্বল শ্রেণীরা মূলতঃ যারা শ্রম দিত অর্থাৎ শ্রমিকেরা এবং সবল শ্রেণী যারা সম্পদ ভোগ করত তারা হয়ে গেল মালিক শ্রেণী। অন্যের শ্রম শোষণ করে নিজে ভোগ করা এটা মানবিক দৃষ্টিতে খুবই অন্যায়। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে পুরাতন প্রস্তর যুগ, নতুন প্রস্তর যুগ, ব্রোঞ্জ, তাম্র, যুগ ইত্যাদি সভ্যতার যুগে ক্রমান্বয়ে মানুষ প্রবেশ করে এবং এই সামাজিক বিভাজন ও আরও অনেক অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতন এসবের সাথে যুক্ত হয়। বৈষয়িক বা বস্তুগত সভ্যতার প্রসার লাভ করে। মানবমনে মানবিকতা ও নৈতিকতা, ন্যায়বিচার, ন্যায়নিষ্ঠতা, মানবপ্রেম ইত্যাদির সৃষ্টির জন্য যুগে যুগে আল্লাহ’তায়ালা মানুষের মাঝে নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন যারা সেই সময়কার অত্যাচারী ও নিপীড়িতের সকলকে আল্লাহর দিকে অর্থাৎ ন্যায় ও সত্যের পথে আহ্বান করেছেন।
সব মানুষের মেধা সমান নয়, কায়িক পরিশ্রম করার ক্ষমতাও সমান নয়। সেজন্য সমাজের মালিক ও শ্রমিকের এই বিভাজন সবক্ষেত্রে অবাস্তব বা অমানবিক সেটাও বলা যায় না। দুনিয়াতে আল্লাহর প্রেরিত নবী-রাসুলগণের মধ্যে দু-একজন ছাড়া সবাই তাদের জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে শ্রমিকের কাজ করেছেন। কাজেই ইসলাম শ্রমিককে সবচেয়ে বেশী মর্যাদা দিবে এটাই স্বাভাবিক। আল্লাহর কালাম ও রাসূলের হাদীসে এসবের সুস্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়।
সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে সমাজজীবন জটিল থেকে জটিলতর হওয়ার পাশাপাশি মানুষের বিবেক, বুদ্ধি, অধিকার সম্পর্কে সচেনতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। শ্রমিক কাজ করবে কিন্তু তার শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন না করে মালিকপক্ষ শ্রমিকের শ্রম শোষণ করে অর্থাৎ মাত্রাতিরিক্ত কাজ করিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলবে এটা হতে পারে না। এসব চিন্তা থেকে ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের পর আমেরিকাসহ উদীয়মান শিল্পভিত্তিক দেশসমূহে শ্রমিক সংগঠন গড়ে ওঠে যারা শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার, মজুরী, কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ-সুরক্ষা, বিনোদন ইত্যাদি নিয়ে সোচ্চার হয়। প্রস্তাব আসে ২৪ ঘন্টায় ৮ ঘন্টা ঘুম, ৮ ঘন্টা পরিশ্রম ও ৮ ঘন্টা বিনোদনের। কিছু মানুষ এর সমর্থনে এগিয়ে আসে আবার কেউ বিরোধীতা করে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীগণ মনে করেন একটানা কেউ ৮ ঘন্টা পরিশ্রম করতে অপারগ। অবশ্যই মাঝে তাকে ১৫ মিনিট করে দু’বার অথবা একটানা ৩০ মিনিট (আধা ঘন্টা) বিশ্রাম ও আহারের সময় দিতে হবে।
মালিকপক্ষ চায় সামান্য কিছু ওভারটাইম দিয়ে শ্রমিককে ১২-১৫ ঘন্টা খাটিয়ে নিতে। কিন্তু এতে শেষ পর্যন্ত শ্রমিকের স্বাস্থহানি ঘটে ফলে শ্রমশক্তির নিরেট অপচয় হয় এবং উৎপাদন শেষ পর্যন্ত কমে যায়। অবিবেচক মালিক হয়তঃ উপস্থিত লাভটাকেই দেখে থাকে। এরূপ একটি পরিস্থিতিতে ১৮৮৬ সালের পহেলা মে (০১ মে) তারিখে আমেরিকার শিকাগো শহরে ৮ঘন্টা কাজের দাবীতে অর্থাৎ ৮ঘন্টার বেশী কাজ না করানোর দাবীতে ব্যপক শ্রমিক বিক্ষোভ হয় যা দমন করতে গিয়ে মালিকপক্ষের রক্ষক হিসেবে কর্তৃপক্ষ বা সরকার শ্রমিকদের উপর গুলি চালায় এবং এতে ছয়জন শ্রমিক নিহত হয়। তবে তাদের রক্তদান বৃথা যায়নি। তাদের আন্দোলন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় এবং আজকের শ্রম আইনে একজন শ্রমিককে ৮ঘন্টা পরিশ্রমের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখিত আছে। শ্রম আইন, শ্রম আদালতও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমনকি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (International Labor Organization) গঠিত হয়েছে যা জাতিসংঘ দ্বারা স্বীকৃত।
১লা মে পৃথিবীর প্রায় সকল সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক, অগণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রে বিশ্ব শ্রমিক দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হয় এবং এটি একটি সরকারী ছুটির দিন। এই দিনে বিভিন্ন শ্রমিক সমাবেশ, র্যালি ও মিছিল রাস্তায় দেখা যায়।
এই সমস্ত কারণে আজকের শ্রমিক আগের জামানার কৃতদাস, শ্রমিকদের মত না। আপনি আপনার বাসায় মিস্ত্রী/শ্রমিক খাটিয়ে দেখেন তাদের কাজ শুরু করার কথা সকাল ৮টায় এবং তখন থেকে আট ঘন্টা অর্থাৎ বিকাল ৪টা (মাঝখানে আধাঘন্টা বিরতিসহ)। অনেকক্ষেত্রে দেখবেন তারা কর্মস্থলে ৯টার পরে উপস্থিত হয়ে ঢিলেঢালাভাবে কাজ শুরু করতে ৯:৩০টা থেকে ১০টা বাজিয়ে দেয় এবং কাজের মাঝখানে আধাঘন্টা কর্মবিরতি নিয়ে থাকে এবং ৪:০০ থেকে ৪:৩০ টা বাজার সাথে সাথে কাজ শিথিল করে বন্ধ করে দেয়। তাতে দেখা যায় সর্বসাকুল্যে ঢিলেমিসহ সর্বোচ্চ ৬/৭ ঘন্টার বেশী কাজ করে না। মালিকের ভদ্রতার ও নির্লিপ্ততার সুযোগ পেলে এর চাইতেও কম কাজ করে থাকে। কাজেই এক্ষেত্রে মালিকের অর্থ শোষিত হচ্ছে। মালিক বেশী কঠোর হলে হয়তঃ কাজ বেশী আদায় হতে পারে সেক্ষেত্রে সেটা হয়ে পড়বে মানব নির্যাতন এবং প্রকৃতপক্ষে বল প্রয়োগে কাজের মান তেমন ভাল হয় না। কাজেই শ্রমিককে তার সর্বোচ্চ সুবিধা ও মনন নিয়েই কাজ করতে হবে এবং তাতে কাজ অনেক সুন্দর ও উন্নত হবে। কাজেই মালিকের প্রতি শ্রমিকেরও একটা নৈতিক দায়িত্ব আছে।
ইসলামে শ্রমিকের প্রতি মালিকের যত্ন নেওয়ার যেমন নির্দেশ আছে তেমনি শ্রমিককেও মালিকের প্রতি যত্ন নেওয়ার নির্দেশ আছে। এটা সম্ভব একমাত্র উভয়ের সুসম্পর্কের মাধ্যমে, পরস্পরের সহমর্মিতার মাধ্যমে। মালিককে শ্রমিককে তার নিজের ভাইয়ের মত মনে করতে হবে। আল্লাহ চাইলে এমনও তো হতে পারতো আজ যে শ্রমিক সেই হতে পারতো মালিক। কাজেই শ্রমিককে সেভাবে সহমর্মিতার দৃষ্টিতে দেখতে হবে। শ্রমিককেও তার মালিকের ভদ্রতার প্রতিদান দিতে হবে। ভদ্রতার সুযোগ নিয়ে তার কাজের ক্ষতি করাটা শ্রমিকের ঈমানের বরখেলাপ হবে। একদিন সবাইকেই আল্লাহর কাছে নিজ কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। মালিককে তার সম্পদ ও তার উপার্জনের জবাব, জবাব দিতে হবে সে কোন শ্রমিকের শ্রম শোষণ করেছে কি না, কাউকে কষ্ট দিয়েছে কি না, কাউকে নির্যাতন করেছে কি না। অপরপক্ষে শ্রমিককেও জবাব দিতে হবে যে সে তার মালিককে ঠকিয়েছে কি না।
ইসলামের দৃষ্টিতে মালিক-শ্রমিক প্রভুভৃত্যের সম্পর্ক নয় বরং ভাই ভাইয়ের সম্পর্ক। নবী করীম (সাঃ) বলেন – “যারা তোমাদের কাজ করছে তারা তোমাদের ভাই, আল্লাহ তাদের তোমাদের অধীন করেছেন, তাদেরও তোমাদের মতো মন আছে, ব্যথাদানে তারাও কষ্ট পায় আবার শান্তিপ্রদান করলে সন্তুষ্ট হয়, তাদের সাথে তোমরা সদ্ব্যব্যবহার করবে”।
তিনি আরও বলেন – “মজুরদের সাধ্যের মাত্রাতিরিক্ত কাজে তাদের বাধ্য করবে না। ঘাম শুকানোর আগেই তাদের মজুরী পরিশোধ করবে”। নবী করীম (সাঃ) নিজেও জীবনের কিছু অংশে মজদুরের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন।
কাজেই সেটা অসম্মানজনক কিছু নয়। চোর, বাটপার, অর্থ কেলেংকারীর সাথে জড়িতরা অসম্মানী হতে পারে কিন্তু একজন রিকসাশ্রমিক নয়।
নবী করীম (সাঃ) শ্রমিকের কর্তব্যের ব্যাপারেও তাগিদ দিয়েছেন। তিনি বলেন “ঐ শ্রমিকের সওয়াব দ্বিগুণ করা হবে যে নিজ মালিকের হক আদায় করে এবং আল্লাহর হকও আদায় করে”। অর্থাৎ আল্লাহর হক আদায়ের নামে কোন শ্রমিক মালিককে ফাঁকি দিলে তার হক আদায় হবে না।
শ্রমিক-মালিক সুসম্পর্কই নিশ্চয়তা বিধান করতে পারে কল-কারখানার উন্নয়ন, উৎপাদনশীলতা, সামাজিক উন্নয়ন ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিধান। কায়িক শ্রমের শ্রমিকের কথা এখানে আলোচনা করা হলেও ব্যাপক অর্থে আমরা সবাই শ্রমিক এবং আমাদের প্রকৃত মালিক মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন।
সৃষ্টির আদিকাল থেকে অর্থাৎ পুরাতন প্রস্তর যুগ থেকে আমরা দেখতে পায় প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করে এবং কায়িক পরিশ্রম করে জীবনে বাঁচার লড়াই। প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সব মানুষের শারীরীক সামর্থ্য যে একইরকম ছিল তা নয়। স্বাস্থ ও শক্তিতে কম-বেশী সব সময় ছিলো। কিন্তু সৃষ্টির আদিকাল থেকেই হিংস্র জীব-জন্তুর আক্রমণ ও প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে বেঁচে থাকা, নিরাপদ আশ্রয় খোঁজা এবং আহার সংগ্রহের জন্য সবাই একে-অন্যকে সাহায্য করত।
কিন্তু বুদ্ধিমত্তায় সেরা এই মানুষ প্রজাতির নিয়ন্ত্রণে প্রকৃতি যত বেশী অধীনে আসতে শুরু করল তত বেশী তাদের মধ্যে ভোগ, আরাম-আয়েশের চিন্তা মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠতে লাগল। নিরন্তর পরিশ্রমের তখন প্রয়োজন অনেক কমে যেতে লাগল। এই সময়ই শারীরিকভাবে শক্তিধর ও বুদ্ধিমান একজন মানুষ তার চাইতে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও কম বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে দিয়ে কায়িক পরিশ্রম করে সম্পদ ও ভোগসামগ্রী সংগ্রহে বাধ্য করল এবং নিজে তা শুধু ভোগ করতে শুরু করল। এইভাবেই শুরু হয় সামাজিক বিভাজন – সবল ও দূর্বল শ্রেণী। দূর্বল শ্রেণীরা মূলতঃ যারা শ্রম দিত অর্থাৎ শ্রমিকেরা এবং সবল শ্রেণী যারা সম্পদ ভোগ করত তারা হয়ে গেল মালিক শ্রেণী। অন্যের শ্রম শোষণ করে নিজে ভোগ করা এটা মানবিক দৃষ্টিতে খুবই অন্যায়। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে পুরাতন প্রস্তর যুগ, নতুন প্রস্তর যুগ, ব্রোঞ্জ, তাম্র, যুগ ইত্যাদি সভ্যতার যুগে ক্রমান্বয়ে মানুষ প্রবেশ করে এবং এই সামাজিক বিভাজন ও আরও অনেক অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতন এসবের সাথে যুক্ত হয়। বৈষয়িক বা বস্তুগত সভ্যতার প্রসার লাভ করে। মানবমনে মানবিকতা ও নৈতিকতা, ন্যায়বিচার, ন্যায়নিষ্ঠতা, মানবপ্রেম ইত্যাদির সৃষ্টির জন্য যুগে যুগে আল্লাহ’তায়ালা মানুষের মাঝে নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন যারা সেই সময়কার অত্যাচারী ও নিপীড়িতের সকলকে আল্লাহর দিকে অর্থাৎ ন্যায় ও সত্যের পথে আহ্বান করেছেন।
সব মানুষের মেধা সমান নয়, কায়িক পরিশ্রম করার ক্ষমতাও সমান নয়। সেজন্য সমাজের মালিক ও শ্রমিকের এই বিভাজন সবক্ষেত্রে অবাস্তব বা অমানবিক সেটাও বলা যায় না। দুনিয়াতে আল্লাহর প্রেরিত নবী-রাসুলগণের মধ্যে দু-একজন ছাড়া সবাই তাদের জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে শ্রমিকের কাজ করেছেন। কাজেই ইসলাম শ্রমিককে সবচেয়ে বেশী মর্যাদা দিবে এটাই স্বাভাবিক। আল্লাহর কালাম ও রাসূলের হাদীসে এসবের সুস্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়।
সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে সমাজজীবন জটিল থেকে জটিলতর হওয়ার পাশাপাশি মানুষের বিবেক, বুদ্ধি, অধিকার সম্পর্কে সচেনতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। শ্রমিক কাজ করবে কিন্তু তার শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন না করে মালিকপক্ষ শ্রমিকের শ্রম শোষণ করে অর্থাৎ মাত্রাতিরিক্ত কাজ করিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলবে এটা হতে পারে না। এসব চিন্তা থেকে ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের পর আমেরিকাসহ উদীয়মান শিল্পভিত্তিক দেশসমূহে শ্রমিক সংগঠন গড়ে ওঠে যারা শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার, মজুরী, কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ-সুরক্ষা, বিনোদন ইত্যাদি নিয়ে সোচ্চার হয়। প্রস্তাব আসে ২৪ ঘন্টায় ৮ ঘন্টা ঘুম, ৮ ঘন্টা পরিশ্রম ও ৮ ঘন্টা বিনোদনের। কিছু মানুষ এর সমর্থনে এগিয়ে আসে আবার কেউ বিরোধীতা করে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীগণ মনে করেন একটানা কেউ ৮ ঘন্টা পরিশ্রম করতে অপারগ। অবশ্যই মাঝে তাকে ১৫ মিনিট করে দু’বার অথবা একটানা ৩০ মিনিট (আধা ঘন্টা) বিশ্রাম ও আহারের সময় দিতে হবে।
মালিকপক্ষ চায় সামান্য কিছু ওভারটাইম দিয়ে শ্রমিককে ১২-১৫ ঘন্টা খাটিয়ে নিতে। কিন্তু এতে শেষ পর্যন্ত শ্রমিকের স্বাস্থহানি ঘটে ফলে শ্রমশক্তির নিরেট অপচয় হয় এবং উৎপাদন শেষ পর্যন্ত কমে যায়। অবিবেচক মালিক হয়তঃ উপস্থিত লাভটাকেই দেখে থাকে। এরূপ একটি পরিস্থিতিতে ১৮৮৬ সালের পহেলা মে (০১ মে) তারিখে আমেরিকার শিকাগো শহরে ৮ঘন্টা কাজের দাবীতে অর্থাৎ ৮ঘন্টার বেশী কাজ না করানোর দাবীতে ব্যপক শ্রমিক বিক্ষোভ হয় যা দমন করতে গিয়ে মালিকপক্ষের রক্ষক হিসেবে কর্তৃপক্ষ বা সরকার শ্রমিকদের উপর গুলি চালায় এবং এতে ছয়জন শ্রমিক নিহত হয়। তবে তাদের রক্তদান বৃথা যায়নি। তাদের আন্দোলন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় এবং আজকের শ্রম আইনে একজন শ্রমিককে ৮ঘন্টা পরিশ্রমের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখিত আছে। শ্রম আইন, শ্রম আদালতও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমনকি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (International Labor Organization) গঠিত হয়েছে যা জাতিসংঘ দ্বারা স্বীকৃত।
১লা মে পৃথিবীর প্রায় সকল সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক, অগণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রে বিশ্ব শ্রমিক দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হয় এবং এটি একটি সরকারী ছুটির দিন। এই দিনে বিভিন্ন শ্রমিক সমাবেশ, র্যালি ও মিছিল রাস্তায় দেখা যায়।
এই সমস্ত কারণে আজকের শ্রমিক আগের জামানার কৃতদাস, শ্রমিকদের মত না। আপনি আপনার বাসায় মিস্ত্রী/শ্রমিক খাটিয়ে দেখেন তাদের কাজ শুরু করার কথা সকাল ৮টায় এবং তখন থেকে আট ঘন্টা অর্থাৎ বিকাল ৪টা (মাঝখানে আধাঘন্টা বিরতিসহ)। অনেকক্ষেত্রে দেখবেন তারা কর্মস্থলে ৯টার পরে উপস্থিত হয়ে ঢিলেঢালাভাবে কাজ শুরু করতে ৯:৩০টা থেকে ১০টা বাজিয়ে দেয় এবং কাজের মাঝখানে আধাঘন্টা কর্মবিরতি নিয়ে থাকে এবং ৪:০০ থেকে ৪:৩০ টা বাজার সাথে সাথে কাজ শিথিল করে বন্ধ করে দেয়। তাতে দেখা যায় সর্বসাকুল্যে ঢিলেমিসহ সর্বোচ্চ ৬/৭ ঘন্টার বেশী কাজ করে না। মালিকের ভদ্রতার ও নির্লিপ্ততার সুযোগ পেলে এর চাইতেও কম কাজ করে থাকে। কাজেই এক্ষেত্রে মালিকের অর্থ শোষিত হচ্ছে। মালিক বেশী কঠোর হলে হয়তঃ কাজ বেশী আদায় হতে পারে সেক্ষেত্রে সেটা হয়ে পড়বে মানব নির্যাতন এবং প্রকৃতপক্ষে বল প্রয়োগে কাজের মান তেমন ভাল হয় না। কাজেই শ্রমিককে তার সর্বোচ্চ সুবিধা ও মনন নিয়েই কাজ করতে হবে এবং তাতে কাজ অনেক সুন্দর ও উন্নত হবে। কাজেই মালিকের প্রতি শ্রমিকেরও একটা নৈতিক দায়িত্ব আছে।
ইসলামে শ্রমিকের প্রতি মালিকের যত্ন নেওয়ার যেমন নির্দেশ আছে তেমনি শ্রমিককেও মালিকের প্রতি যত্ন নেওয়ার নির্দেশ আছে। এটা সম্ভব একমাত্র উভয়ের সুসম্পর্কের মাধ্যমে, পরস্পরের সহমর্মিতার মাধ্যমে। মালিককে শ্রমিককে তার নিজের ভাইয়ের মত মনে করতে হবে। আল্লাহ চাইলে এমনও তো হতে পারতো আজ যে শ্রমিক সেই হতে পারতো মালিক। কাজেই শ্রমিককে সেভাবে সহমর্মিতার দৃষ্টিতে দেখতে হবে। শ্রমিককেও তার মালিকের ভদ্রতার প্রতিদান দিতে হবে। ভদ্রতার সুযোগ নিয়ে তার কাজের ক্ষতি করাটা শ্রমিকের ঈমানের বরখেলাপ হবে। একদিন সবাইকেই আল্লাহর কাছে নিজ কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। মালিককে তার সম্পদ ও তার উপার্জনের জবাব, জবাব দিতে হবে সে কোন শ্রমিকের শ্রম শোষণ করেছে কি না, কাউকে কষ্ট দিয়েছে কি না, কাউকে নির্যাতন করেছে কি না। অপরপক্ষে শ্রমিককেও জবাব দিতে হবে যে সে তার মালিককে ঠকিয়েছে কি না।
ইসলামের দৃষ্টিতে মালিক-শ্রমিক প্রভুভৃত্যের সম্পর্ক নয় বরং ভাই ভাইয়ের সম্পর্ক। নবী করীম (সাঃ) বলেন – “যারা তোমাদের কাজ করছে তারা তোমাদের ভাই, আল্লাহ তাদের তোমাদের অধীন করেছেন, তাদেরও তোমাদের মতো মন আছে, ব্যথাদানে তারাও কষ্ট পায় আবার শান্তিপ্রদান করলে সন্তুষ্ট হয়, তাদের সাথে তোমরা সদ্ব্যব্যবহার করবে”।
তিনি আরও বলেন – “মজুরদের সাধ্যের মাত্রাতিরিক্ত কাজে তাদের বাধ্য করবে না। ঘাম শুকানোর আগেই তাদের মজুরী পরিশোধ করবে”। নবী করীম (সাঃ) নিজেও জীবনের কিছু অংশে মজদুরের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন।
কাজেই সেটা অসম্মানজনক কিছু নয়। চোর, বাটপার, অর্থ কেলেংকারীর সাথে জড়িতরা অসম্মানী হতে পারে কিন্তু একজন রিকসাশ্রমিক নয়।
নবী করীম (সাঃ) শ্রমিকের কর্তব্যের ব্যাপারেও তাগিদ দিয়েছেন। তিনি বলেন “ঐ শ্রমিকের সওয়াব দ্বিগুণ করা হবে যে নিজ মালিকের হক আদায় করে এবং আল্লাহর হকও আদায় করে”। অর্থাৎ আল্লাহর হক আদায়ের নামে কোন শ্রমিক মালিককে ফাঁকি দিলে তার হক আদায় হবে না।
শ্রমিক-মালিক সুসম্পর্কই নিশ্চয়তা বিধান করতে পারে কল-কারখানার উন্নয়ন, উৎপাদনশীলতা, সামাজিক উন্নয়ন ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিধান। কায়িক শ্রমের শ্রমিকের কথা এখানে আলোচনা করা হলেও ব্যাপক অর্থে আমরা সবাই শ্রমিক এবং আমাদের প্রকৃত মালিক মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন।
Post Views: 28