ঈমাম মাহদী (আঃ) এর দলের প্রতীক্ষায়

Imam Mahdi

সাধারণতঃ দল বলতে বুঝায় Social Gathering। অর্থাৎ, কোন বিশেষ উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে কিছু লোক একত্রিত হওয়াকে দল বলে। তাহলে সভা বা meeting এর সাথে এর পার্থক্য কি? পার্থক্য হচ্ছে meeting বা সভা একটা ক্ষণস্থায়ী সময়ের জন্য হয়ে থাকে। কিন্তু দল একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে কিছু একই চিন্তা-ভাবনার লোকজনের একত্রিত হওয়াকে বুঝায় যা ক্ষণস্থায়ী নয়। একটা অব্যাহত প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে তার কার্যক্রম চলতে থাকে।

দল গঠনের উদ্দেশ্যঃ

মানুষ একা থাকতে পারে না। জীব হিসাবে তার আহার, নিদ্রা, প্রজননের জন্য অন্যের সাহায্যের প্রয়োজন হয়। এর উপর মানুষতো কোন সাধারণ জীব নয়, ¯্রষ্টার সৃষ্ট একটি অসাধারণ জীব। কাজেই সে একা চলবে কেন? তাকে একটা নি¤œস্তরের জীবের মত আল্লাহ’তায়ালা সৃষ্টি করেননি, সৃষ্টি করেছেন নিজ খলীফা হিসেবে। কাজেই তার জীবন-যাপন পদ্ধতিও সম্পূর্ণ ভিন্নতর। তার বিদ্যা-বুদ্ধি, বিবেক সবকিছুই আছে। ¯্রষ্টাকে চেনা ও স্বীকার করা বা তাকে অস্বীকার করার ক্ষমতা তার সবকিছুই আছে। বিভিন্ন মানুষের চিন্তাধারা বিভিন্ন হলেও চিন্তুধারার সাদৃশ্যও আছে। সাদৃশ্য থাকলে আমরা তাদের সমমনা বলে থাকি। সামাজিকক্ষেত্রে এই সমমনা লোকজন বিক্ষিপ্তভাবে অবস্থান করতে থাকে। কিন্তু যদি তারা নিয়মিত একত্রিত হয়ে নিজেদের ভাব ও মতামতের আদান-প্রদান করে তবে সেটাই হয়ে ওঠে একটা দল।

দলের প্রকারভেদঃ

দল বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে যা অত্যন্ত নিকৃষ্ট, অশ্লীল, পদলোভী, সুবিধালোভী, ক্ষমতালোভী, অর্থলোভী হওয়ার কারণে দল সৃষ্টি ইত্যাদি থেকে শুরু করে অনেক উৎকৃষ্ট ও সুন্দরতমও হতে পারে। তাদের আদর্শ ও চলাফেরা দেখে বুঝা যাবে সে দলটি কি প্রকৃতির।

সাধারণতঃ ‘দল’ বা ‘পার্টি’ বা ‘গ্রুপ’ বলতে অনেকসময় রাজনৈতিক বলে মনে করেন অনেকে। কিন্তু এটা সঠিক নয়। দল বিভিন্ন ধরণের সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সকল প্রকার হতে পারে।

একথা ঠিক যে, ব্যক্তি থেকে সমাজ তৈরী হয় এবং সেই সমাজকে কিছু আইন-শৃঙ্খলার বন্ধনে শৃঙ্খলিত করার জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রের এবং রাষ্ট্র পরিচালনা যন্ত্রের। রাষ্ট্র পরিচালনার যন্ত্রটি একটি খুবই আকর্ষনীয় ব্যপার। আমি সবার উপর কর্তৃত্ব করব, যা খুশি ভোগ-বিলাস করব, আদেশ-নিষেধ করতে পারব, সবাই আমাকে মেনে চলবে – এরকম একটা আত্মতৃপ্তির অনুভূতি থেকে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতি লোভাতুর দৃষ্টি যুগে যুগে মানুষের মধ্যে হয়ে আসছে। এটা একটা শয়তানি ওয়াস-ওয়াসা বা তাগুতী প্ররোচনা। এর বিপরীতে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠার জন্য তার মনোনীত বান্দাগন পৃথিবীতে আগমন করেছেন। মানুষকে অপর মানুষের অর্থাৎ ঐ রাষ্ট্রযন্ত্র, সামাজিক ও ব্যক্তিশৃঙ্খল থেকে টেনে মুক্ত করে ¯্রফে আল্লাহর ইবাদতী জিন্দেগী ও পরকালীন মুক্তির দিক-নির্দেশনা দেওয়ার জন্য। এটাও প্রচ্ছন্নভাবে কিছুটা রাজনৈতিক হয়ে যায় বটে। তবে এই রাজনীতি প্রচলিত রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। ব্যক্তি ও সমাজ সংশোধন করতে গিয়ে এখানে কিছুটা রাজনীতি চলে আসে। রাজনৈতিক শক্তি ছাড়া সমাজ ও ব্যক্তি নিয়ন্ত্রণ হয় না। এটা অনেকটা নিম্নরূপঃ

ব্যক্তি সংশোধন → সমাজ সংশোধন → রাজনীতি ও রাষ্ট্র

একটা নিরেট ধর্মীয় দল কখনও তথাকথিত রাজনৈতিক অভিলাস নিয়ে অগ্রসর হতে পারে না। ব্যক্তির ঈমান আকীদার সংশোধন, উন্নত ও বিশুদ্ধ আত্মিক আমল করে পারলৌকিক মুক্তির জন্য কাজ করবে এটাই তার লক্ষ্য।

দলের প্রয়োজন কেন?

প্রয়োজন এজন্য যে, ঈমানের বুনিয়াদ শক্ত রাখার জন্য পরস্পরের একত্রে থাকা ও চিন্তাধারা আদান-প্রদান প্রয়োজন নচেৎ একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিশুদ্ধতার ক্ষেত্রে স্খলন দেখা দিতে পারে।

ব্যক্তির সংশোধন, দলের সংশোধন পাশাপাশি সামাজিক সংশোধন হয়ে স্বাভাবিকভাবে একটা রাষ্ট্রীয় সংশোধনে রূপলাভ করবে তবে তা বিনা প্রচেষ্টায় নয়।

রাষ্ট্রের প্রচলিত নীতিমালা ও আইনবিধি যা সমাজ ও ব্যক্তির ইসলামী আমলের জিন্দেগীকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে তখন ঐ দল নীরব দর্শক হয়ে থাকবে না বা থাকাটা ধর্মীয় Spirit এর বিরোধী। কাজেই তথন সে অবশ্যই রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর চাপ প্রয়োগ করবে। ধর্মীয় নীতি আদর্শ ও মানবতার জন্য ক্ষতিকর আইনগুলোকে পরিবর্তন করার জন্য। রাষ্ট্রযন্ত্রের অধীশ্বর যখনই এইরূপ আবদার শুনবে না তখনই তার সাথে সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি হবে। এটার নামই রাজনৈতিক আন্দোলন। এই আন্দোলনের বিভিন্নরূপ কর্মসূচি থাকতে পারে। তবে তথাকথিত পাশ্চাত্য পদ্ধতির সাথে এই রাজনীতির অনেক গরমিল থাকবে। এখানে ছলে, বলে, কৌশলে জনগণের ম্যান্ডেট নেওয়ার প্রবণতা থাকবে না। ব্যক্তি ও সমাজ সংশোধনের আন্দোলন কখনও কদাচিৎ রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে দেখা দিতে পারে। তবে এক্ষত্রে ব্যক্তির আত্মিক সংশোধন ও আমল-আখলাক ও চরিত্র, ইবাদতী বা খোদাভীতির জিন্দেগীকে বিসর্জন দিয়ে নয়। এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সকল মানুষই যে এইরকম চরিত্র-মাধুর্য্যরে অধিকারী হবে এটা আশা করা ঠিক নয়। সবাইকে accommodate করেই যে কোন আন্দোলন করতে হয়। তবে কখনও নিজস্ব Spirit বিসর্জন দিয়ে নয়। বিশেষতঃ নেতৃস্থানীয়দের খুবই চিন্তাশীল, ধীরস্থির, খোদাভীতি সম্পন্ন ও নিরেট ধার্মিক হতে হবে। তথাকথিত বেশভূষা, লোকদেখানো আবেগ আর কথাপটু ও যুক্তিবাদী হলে চলবে না। মনের উপলব্ধি অর্থাৎ ধর্মীয় উপলব্ধি, চেতনাবোধ প্রতিটিক্ষেত্রে ইসলামের ন্যায়-অন্যায়ের মানদন্ড মনে সদা জাগরুক রেখে আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে যথাসম্ভব ভুলের উর্ধ্বে থেকে সীমালঙ্ঘন না করে এই রাস্তায় চলতে হবে।

বর্তমান বিশ্বের ধর্মীয় দলসমূহঃ

উল্লেখ করা আবশ্যক যে, এখানে ইসলাম ছাড়া অন্যান্য ধর্মীয় দল নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে না। কারণ অন্যান্য ধর্ম থেকে ইসলামধর্ম সম্পূর্ণ আলাদা। কারণ অন্যান্য ধর্মে মানুষের ব্যক্তিগত ও আধ্যাত্মিক চাহিদা মেটাতে পারলেও সামাজিক রীতিনীতি, বিধি-বিধান ও সমাজবদ্ধতা, মানুষের ঐক্যবদ্ধতা ও আইন-কানুন, অর্থ ব্যবস্থা, বিচার, প্রশাসন ইত্যাদির দিক থেকে পূর্ণাঙ্গ নয়। এটার কারণ এই যে ধর্মীয় দিক থেকে ইসলাম হচ্ছে আধুনিকতম। কাজেই আধুনিক যুগের অনেক যুগচাহিদা, মনের চাহিদা ইসলামধর্ম মেটাতে সক্ষম যা অন্যান্য ধর্ম যেমন – খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ, হিন্দুধর্ম ইত্যাদি দ্বারা সম্ভব নয়। অতএব ঐ সমস্ত ধর্মের অনুসারী মানুষের তাদের মনের আত্মিক ও আধ্যাত্মিক চাহিদা পূরণ হলেও সামাজিক বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব মনগড়া বা প্রচলিত প্রথা, আইনকানুন মেনে চলতে হয় যা অনেকক্ষেত্রে তারা যে ধর্মীয় স্পিরিটের কথা বলে তার সাথে মিল নেই। এটাকে আমরা ধর্মনিরপেক্ষতা বলি। কার্যত ধর্মের প্রভাব সমাজ ও রাষ্ট্রের উপর না থাকাকেই ধর্মনিরপেক্ষতা বলে। অন্য ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণু থাকাকে বলা হয় ধর্মীয় উগ্রবাদ। বিপরীতক্রমে অপর ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণু না হওয়ার অর্থ ধর্মনিরপেক্ষতা নয়। অনেকের মাঝে এরকম একটা ভুল ধারণা আছে যে সবধর্মের লোক ধর্ম ঠিকমত পালন করার নাম ধর্মনিরপেক্ষতা।

ধর্মনিরপেক্ষতা কথাটি রাষ্ট্রীয় বা শাসনযন্ত্রের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এখানে যদি ধর্ম থেকে বা ধর্মীয় নীতিমালা থেকে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক নীতিমালা সম্পূর্ণ আলাদা থাকে তবে সেটা হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। অন্যকথায়, রাষ্ট্র ও সমাজযন্ত্রে কোনক্ষেত্রে ধর্ম নাক গলাতে পারবে না। এটার নাম ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতাকে এককথায় বলা যেতে পারে ঐসব ক্ষেত্রে ধর্মের অনুপস্থিতি বা ধর্মহীনতা।

বর্তমান পৃথিবীতে অনেকগুলো ধর্মীয় দল আছে, আমাদের দেশেও আছে এবং সেগুলো কয়েক ধরণের। সেগুলি নিম্নরূপঃ-

১. উগ্রবাদী ধর্মীয় দলঃ এইসব দল প্রথম থেকেই একটা আক্রমনাত্মক ও প্রতিহিংসাপরায়ন মনঃবৃত্তি নিয়ে সমমনা লোকদের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে। এইদলগুলো reactionary-ও হতে পারে। কোন যুদ্ধে হয়ত তাদের সর্বস্ব খোয়া গেছে তাই মনের রাগে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য এইপথ বেছে নিয়েছে।
অথবা, এদেরকে কেউ ইসলামের পূর্নাঙ্গ ইতিহাস, শিক্ষা ও পূর্নাঙ্গরুপ না বুঝিয়ে খন্ডাংশ বুঝিয়েছে এবং তাদের নির্বুদ্ধিতা ও অপূর্নাঙ্গ শিক্ষার সুযোগ নিয়ে তাদের এই রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছে (যেমন – আমরা পত্র-পত্রিকায় দেখতে পায় বিভিন্ন ধর্মীয় জঙ্গীগোষ্ঠীর নাম)।
A little learning is a dangerous thing ‘অল্পবিদ্যা ভয়ংকারী’, এই প্রবাদটি অনেক ধর্মীয় দলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এরা ইসলামের লেবেল লাগিয়ে ও অপব্যাখ্যা দিয়ে এহেন কোন দুষ্কর্ম নাই যা তারা করতে পারে না। ইসলামের ইতিহাসে খারিজিদের সম্পর্কে আমরা সবাই জানি। উগ্রবাদী খারিজিরা ধর্মের নামে কি ভয়ংকর অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ শুরু করেছিল যা শেষ পর্যন্ত হযরত আলী (রাঃ) এর হত্যাকান্ড পর্যন্ত গড়ায়।

২। নমনীয় ধর্মীয় দল (moderate Islamic party)
এইদলগুলোর মধ্যে প্রধানতঃ পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষাপ্রাপ্ত অনুসারীরাই বেশী। এদের মনঃমস্তিষ্ক পাশ্চাত্য গণতান্তিক চিন্তাধারায় আচ্ছন্ন। কাজেই, ইসলামকে এরা ঐ ধ্যান-ধারণা ও ব্যাখ্যা দিয়ে সাইজমত তৈরী করে নিজেদের মধ্যে প্র্যাকটিস করে ও প্রচার করে। এদের মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়ে আসে ইবাদাতসমূহের আধ্যাত্মিক তাৎপর্যের পরিবর্তে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মাধ্যমে শারীরিক উপকারিতা, গিরাসমূহের সঞ্চালনের ব্যায়াম, ওযুর মাধ্যমে উন্মুক্ত স্থানসমূহের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, রোজার মাধ্যমে শরীরের অনেক রোগবালাই দূরীভূত হওয়া, যাকাতের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সাম্যতা, হজ্জের মাধ্যমে বিশ্ব মুসলিম ঐক্যের কথা। এরা প্রকারান্তরে ধর্মের বস্তুবাদী ব্যাখ্যাদান করে এবং তা থেকে উপকার খোঁজে। ইসলামে ¯্রষ্ঠার সাথে সম্পর্কের আত্মিক উন্নতি ও আধ্যাত্মিক উন্নতি ও বিকাশের উপলব্ধি, ধ্যান, চিন্তা-চেতনা, পরকাল ও মুক্তি, ক্ষণস্থায়ী জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করা, পরকালীন মুক্তির জন্য সদা সর্বদা চিন্তিত থাকা ইত্যাদি ব্যপারে অনেকটা উদাসীন। যদিও বাহ্যিক ইসলামী রীতিনীতি ও ইবাদত পালন তারা চালিয়ে যায় কিন্তু মনস্তাত্মিক দিক থেকে ইহকালীন জীবনকে পরকালীন মুক্তির চেয়ে বেশী অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। 
 
৩। অনমনীয়, এককেন্দ্রিক চিন্তাধারণার ইসলামী দলঃ এই দলগুলো নিরেট আলেম ওলামাদ্বারা গঠিত। পূর্নাঙ্গ ইসলামী জ্ঞানের দাবীদার কুরআন, হাদীস, ফিকাহ শাস্ত্র ইত্যাদিতে যথেষ্ট পারদর্শী। কিন্তু আধুনিক ইতিহাস, সমাজ, সমাজ-বিপ্লব, রাষ্ট্রব্যবস্থা, অর্থ-ব্যবস্থা, জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞানের অপ্রতুলতা এইগ্রুপের মধ্যে পাওয়া যায়। এদের মধ্যে পাশ্চাত্য ধ্যানধারণার সংমিশ্রণ না ঘটায় ধর্মের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা তারা দেন না বটে তবে যে ব্যাখ্যাগুলো দিয়ে থাকেন তা আধুনিক যুগচাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়। ফলে আধুনিক যুবসমাজ এটিকে সেকেলে মনে করে পরিহার করে বা প্রত্যাখ্যান করে। 
 
৪। পরিপক্ক ও সার্বিক জ্ঞানসম্পন্ন ইসলামী দলঃ এরকম দল বাস্তবে বিশ্ব মুসলিম সমাজে অনেকটা অপ্রতুল তবে একেবারে অনুপস্থিত নয়। আল্লাহ’তায়ালা নবী প্রেরণের সিলসিলা শেষ নবী হয়রত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর মাধ্যমে সমাপ্ত করলেও যুগে যুগে ইসলামী আদর্শের পূর্নাঙ্গ ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে ও সমকালীন বিশ্বসমাজ সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল এরকম দক্ষ ব্যক্তি প্রেরণ করেছেন যারা আল্লাহর ওহী দ্বারা পরিচালিত না হলেও বিশ্বে ইসলামী সংস্কারক (হুজ্জাতুল ইসলাম) হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। 
তারা প্রচলিত মুসলিম সমাজের বিভ্রান্তি, শয়তান কর্তৃক পথভ্রষ্টতা, নীতি আদর্শের বিচ্যুতি, র্শিক, বেদাত ইত্যাদি সম্পর্কে মুসলিম সমাজকে সচেতন করেছেন এবং সংস্কার সাধন করেছেন। তারা একাকী এই কাজ করেননি। এই কাজ করতে যেয়ে স্বাভাবিকভাবেই তাদের মতামতের সমর্থনে দল তৈরী হয়েছে এবং তারা মুসলিম সমাজ সংস্কারের নিরলস সংগ্রাম করে নিজেদেরকে আল্লাহর খাঁটি সংস্কারক বান্দা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। 

হযরত ঈমাম মাহাদী (আঃ) এর আগমনঃ

এরূপ আধুনিক মুসলিম সমাজের তথা বিশ্ব মানব সমাজের ভ্রান্তির বা খোদাকে ভুলে যেয়ে ভ্রান্তপথে চলার রাস্তা থেকে শেষ জামানার মানুষকে সঠিক পথে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য আল্লাহ’তায়ালা একজন সংস্কারক তাঁর শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর বংশ থেকে মানুষের মাঝে প্রেরণ করবেন। তিনি হচ্ছেন হযরত ঈমাম মাহাদী (আঃ)। তিনি নবী হিসেবে নয় বরং শেষ নবীর উম্মত হিসেবে এবং একজন ঈমাম বা ধর্মীয় নেতা হিসেবে আবির্ভূত হবেন। তার মর্যাদা এতই উপরে হবে যে সমসাময়িককালে আল্লাহ’তায়ালা হযরত ঈসা (আঃ) কে পুনরায় পৃথিবীতে যখন পাঠাবেন তখন ঈমাম মাহাদী (আঃ) একই নামাজে ঈমামতি করবেন যেখানে হযরত ঈসা (আঃ) তার মুক্তাদি হবেন অর্থাৎ তার পেছনে নামাজ পড়বেন

শেষ জামানাঃ

এখন এই শেষ জামানাটি কি? এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোন প্রমাণ সাপেক্ষে সময় নির্ধারণ করা কঠিন। অনুমানভিত্তিক আমরা যা চিন্তা করি তা অনেকক্ষেত্রেই সঠিক হয় না। নবীজি (সাঃ)-র কথায় “যেদিন দাসীর ছেলে রাজা হবে” ইত্যাদি কথাগুলো হয়ত প্রচলিত আছে কিন্তু স¤্রাট হালাকু খান বাগদাদ ভিত্তিক মুসলিম সা¤্রাজ্য ধ্বংসের পর দাসবংশ খলিফারূপে আবির্ভূত হয়। তাহলে কি সেটাই শেষ জামানা ছিল? শেষ জামানার পরে নিশ্চয়ই কেয়ামত, তাহলে শেষ জামানা কত দীর্ঘ হবে তাও আমরা জানিনা। তবে একটা জিনিস ঠিক যে অবশ্যই নবীকরীম (সাঃ) এর ভবিষ্যৎবাণী মিথ্যা হবেনা এবং ঈমাম মেহেদী (আঃ) নবী বংশীয় একজন সংস্কারক বা ঈমাম বা নেতা আসবেন যিনি সে সময়কার প্রচলিত সমাজ সংশোধনে নেতৃত্ব দিবেন এবং বিশুদ্ধ ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করবেন। তিনি ৭-৯ বৎসর পর্যন্ত শ্বাসনকার্য পরিচালনা করবেন। তার নেতৃত্বে যে দলটি তৈরী হবে তা হবে বিশুদ্ধ ইসলামী দল বা “আল জামাত” এবং মুসলমান দাবীদার প্রত্যেককে এই দলকে অনুসরণ করা ফরজ হয়ে যাবে। অনুসরণ না করাটা ‘কুফরী’র পর্যায়ে পড়ে যাবে

বর্তমানে এখন আমরা কি করব?

ঈমাম মেহেদী (আঃ) আমাদের কোন প্রজন্মের জীবদ্দশায় আগমন করবেন তা আমরা জানি না তবে কি আমরা ঐ আগমনের আশায় বর্তমানে চুপচাপ বসে থাকব? এটা কি সমীচিন হবে? আমরা যদি বর্তমানে দলবদ্ধ অবস্থান না নিই তবে আমাদের চিন্তাধারা, আকীদা বিশ^াসের কমতি হতে হতে ক্রমশঃ ক্ষয়িষ্ণু পর্যায়ে চলে যাবে তখন ঈমান আমল নিতান্ত ব্যাক্তি পর্যায়ের সীমাবদ্ধতায় আটকে যাবে এবং অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়বে যা ইসলামী স্পিরিটের সম্পূর্ণ খেলাপ। কাজেই আমাদের একতাবদ্ধ বা দলবদ্ধভাবেই ঈমান আকীদা রক্ষায় কাজ করতে হবে। এরূপ ঈমান আকীদা রক্ষার দল আমাদের সমাজে অরাজনৈতিক দল হিসেবে অনেক আছে তবে তারা ব্যাক্তিগত ইবাদতের বাইরে এক কদমও নড়েন না। ফলে সমাজ সংশোধন ও বিচ্যুতির মৌলিক প্রতিবাদটুকু করার প্রয়োজনবোধ করেন না। এরূপ দুর্বল মেরুদন্ডহীন ঈমানদার সমাজ ও পৃথিবীর কোন কাজে আসে না। ‘আমি নিজের জন্য’ ‘অন্য কারোর জন্য নয়’ এরূপ স্বার্থপর ব্যাক্তি প্রকৃত অর্থে অধার্মিক। তাই সংস্কারকসুলভ কোনরূপ জ্ঞানবুদ্ধির চর্চা ও প্রচেষ্টা না থাকাটা শেষ নবীর উম্মতের চেতনাবোধের বিরোধী। এরূপ দলকে পূর্নাঙ্গ পরিপক্ক জ্ঞান সম্পন্ন ইসলামী দল কখনও বলা যাবে না।

আমাদের করণীয় হচ্ছে, ঈমাম মাহাদী (আঃ) আমাদের জামানায় না আসলেও নবীজির নির্দেশমত আমরা একত্রিত হয়ে আত্মসংশোধনমূলক ইসলামী দল চালিয়ে যাবো এবং প্রয়োজনে সমাজ ও রাষ্ট্র সংশোধনের প্রচেষ্টা চালাবো। এতে কখনও যদি আল্লাহ’তায়ালা সমাজ নিয়ন্ত্রণের এবং রাষ্ট্রযন্ত্র নিয়ন্ত্রণের সুযোগ করে দেন, রাষ্ট্রক্ষমতা একটা সমাজবিপ্লবের মাধ্যমে দখলে আসে তাহলে সেটা আল্লাহর আশীর্বাদ এবং আমানত হিসেবে গ্রহণ করতে হবে ও কাজে লাগাতে হবে।

অন্যথায় এই দল সমাজে বিরাজমান থেকে সত্যিকার আত্মিক সংশোধন, সমাজ সংশোধনের কাজ চালিয়ে যাবে এবং এই বিপ্লবের পথযাত্রায় ঈমাম মাহাদী (আঃ) কে স্বাগত জানানোর জন্য উন্মুখ হয়ে থাকবে এবং নিজেদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। সুন্দরকে পাওয়া, ভালবাসার জিনিসের জন্য অপেক্ষাতেও একটা আনন্দ ও তৃপ্তির অনুভূতি ও অনুপ্রেরণা জাগে। ঈমাম মাহাদী (আঃ) এর আগমন আমাদের ক্ষেত্রেও তদ্রুপ।

বলা বাহুল্য – এরূপ ইসলামী দল সত্যিই বিরল তবে সমমনারা মিলে চিন্তাভাবনা করে অগ্রসর হলে অনুরূপ দল খুঁজে পাওয়া বা তৈরী করা অসম্ভব নয়।

পাদুটিকা-১ঃ বিশিষ্ট তাবেইন ও ঈমাম বুখারীর (রহঃ) অন্যতম বর্ণনাকারী হযরত মুহাম্মদ ইব্নে শিরিন (রহঃ) হতে বর্নিত যে “ঈমাম মাহাদী (আঃ) এই উম্মতের মধ্য থেকেই আসবেন। তিনি হযরত ঈসা (আঃ) এর ঈমামতি করবেন” (মূসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ হা/৩৮৮০৪)।

পাদুটিকা-২ঃ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন “আমার উম্মতের মাঝে মাহাদীর আত্মপ্রকাশ হবে। তিনি সর্বনিম্ন সাত বৎসর আর সর্বোচ্চ নয় বৎসর শাসনকার্য পরিচালনা করবেন” (সুনানে ইবনে মাজাহ হা/৪০৮৩)। অপর হাদীস, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, “শেষ জামানায় আমাদের বংশ হতে তিন ব্যক্তি আগমন করবেন – সাফফা, মানসুর ও ঈমাম মাহাদী (আঃ)” (বায়হাক্কী, দালায়েলুন নবুয়্যত ৬/৫১৪)।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top