‘রূহ্’ সম্পর্কিত কিছু কথা

Soul, light

মৃত্যু বা Death মানেই মানব জীবনের পরিসমাপ্তি নয়। জড়বাদীরা মনে করে সবকিছুর এখানেই শেষ। কাজেই জীবনকে যত রকম, যথেচ্ছা ভাল-মন্দ সবরকমের কর্ম করে এখানেই শেষ করে জীবনের ইতি টানতে হবে এটাই তাদের বিশ্বাস। কিন্তু আধ্যাত্মবাদীরা মনে করে জীবনের এখানেই শেষ নয়। এটা জীবনের একটি পর্যায় অতিক্রম মাত্র। সৃষ্টির শুরুতে রুহের অবস্থান ছিল ‘সৃষ্টিকর্তার একটা হুকুম’। ঐ হুকুমের কারনে মানবাকৃতির জড় দেহ সচল হয়ে একজন জীবন্ত মানুষে রূপধারন করে এবং ঐ রূহটি তার মস্তিষ্ক, উদর, হাত-পা ইত্যাদিতে ছড়িয়ে পড়ে তাকে সচল করেছে (হযরত আদম (আঃ) সৃষ্টি)।

কিন্তু যেহেতু আল্লাহতায়ালা রূহ সম্পর্কে মানুষকে খুব কম জ্ঞান দান করেছেন তাই এ নিয়ে আমাদের ধারনা খুব কম। কোরআন, হাদীস, ইজমা, কিয়াস থেকে যতটুকু জ্ঞান পাওয়া যায় তাতে আছে নানা ধরনের মতদ্বৈততা ও speculation যার যথার্থতা আল্লাহই ভাল জানেন। তাই বলে যুগে যুগে ইসলামী দার্শনিকগন থেমে থাকেননি। যুগে যুগে এব্যপারে অনেকেই উৎসাহের সাথেই কাজ করেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম – ঈমাম গাজ্জালী (র), আবু মোহাম¥দ ইবনে হাযম (র), ঈমাম ইবনে তাইমিয়া (র), আল্লামা হাফিজ ইবনে কাইয়াম (র) প্রমুখ।

বর্তমানে রুহ্ সম্পর্কে আল্লামা হাফিজ ইবনে কাইয়াম (র) এর রচিত ও শায়খ মোহাম্মদ আব্দুররব চিশতির অনুদিত বইটি থেকে এ সম্পর্কে অনেক জ্ঞান লাভ করা যায়।
প্রকৃতপক্ষে মানুষের মৃত্যুর পর পরজগতে গিয়ে কেও ফিরে আসলে অনেক সমস্যার সহজ সমাধান হত। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা এ রহস্যটি উন্মুক্ত করে দেননি এবং সেই জগতে একবার প্রবেশ করলে কেও ইহজগতে ফিরে আসতে পারবে না।

এ কথাটি ভেবে মানুষ মাত্রই একটি মনব্যথা অনুভব করে। এই প্রেম ভালবাসার সংসার ছেড়ে একাকী ‘রূহ্’ মৃত্যুর পর বিদায় নিবে। কোন যোগাযোগ থাকবেনা এই পৃথিবীর মানুষের সাথে, আপনজনের সাথে এ কথা ভেবে। প্রয়াত কবি গোলাম মোস্তফার একটি পংক্তি আমার মনে পড়ে –

‘মরন কি এনে দিবে আঁখিকোনে অন্ধ আবরণ
এপার-ওপার মাঝে রবে না কো কোনই বন্ধন’

কবির মত সব মানুষেরই মনের কথা ও জিজ্ঞাসা একই রকম।

মৃত্যু কি?

বিজ্ঞানের ভাষায় মুত্যু মানে মূলত ‘Brain Death’। অর্থাৎ Brain স্বয়ংক্রিয়ভাবে যে সমস্ত vital organ কে চালাচ্ছিল তা যদি বন্ধ করে দেয় তবে তাকে মুত্যু বলে। Brain ছাড়া অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন হাত-পা অসাড় হলেও তাকে মৃত বলা হয় না। আবার শুধুমাত্র Brain এর higher function নষ্ট হয়ে গেলেও তাকে ‘Brain Death’ বলা হয় না। যেমন – stroke, delirium, dementia অন্যান্য মনোবৈকল্যসমূহ হলেও ‘Brain Death’ বলা হয় না। কিন্তু Brain এ যদি এমন কিছু ঘটনা ঘটে যার ফলে শরীরের vital center যেমন – respiratory এবং cardiac center সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে পড়ে তখনই মৃত্যু হয়। হাত পা ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে তখনও degeneration না হলেও মানুষটির মৃত্যু ঘটেছে বলা হয়। কাজেই Death declaration এর জন্য physical death-ই যথেষ্ট। Molecular death এর প্রয়োজন নেই। এর কারন এই যে ঐ death থেকে তো আর ঐ ব্যক্তি ফিরে আসতে পারবে না।

যে কোন দূর্ঘটনার কারণে আকষ্মিকভাবে অথবা অসুস্থতার কারণে ধীরে ধীরে Brain Death হতে পারে। দেহটির বিনাশ হবে, রূহের বিনাশ নাই যদিও দেহ ও রূহ উভয়ই আল্লাহর সৃষ্টি। রূহটি আল্লাহ নিজের কাছে ফিরিয়ে নেন এবং বিচারমাফিক ঐ রূহের কৃতকর্ম অনুযায়ী কোন এক স্থানে পাঠিয়ে দেন এবং কেয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষণ করেন।


মৃতের শরীর থেকে রূহের নিস্ক্রান্ত হওয়াকে বলা হয় ‘জান কবজ’ যা মালাকুল মউত করে থাকে। অন্যান্য ফেরেশতারা সেটা নিয়ে আল্লাহর দরবারে হাজির করে। রূহটির যদি প্রয়োজন না থাকতো তবে সেটাকে গ্রেফতার করার প্রয়োজন হত না। মৃত্যুর পর তার হয়তো অন্য কোন পরিণতি হতো।

বাহ্যিক মৃত্যুর (Apparent death) পরও কিছু কিছু মানুষ পূনরায় জীবিত হয়। এটা একটা sleep like state কিন্তু রুগীর কোন রক্তচলাচল ও শ্বাস চলাচলের কোন নমুনা থাকে না। এই অবস্থাকে death trance বলা হয়। এক্ষেত্রে আসলে মৃত্যুর ফেরেশতা তার জান কবচ করেনি। তাহলে দেখা যাচ্ছে জান কবচ করে নিয়ে যাওয়াই প্রকৃত মৃত্যু।

মৃত্যুর সাথে সাথেই জান কবচ করা হয় নাকি জান কবচের পরেই মৃত্যু হয় – এটাও একটা প্রশ্ন। তবে দুটির ব্যবধান এতই সুক্ষ্ম যে দুটিকে আলাদা করা যায় না। উপরে বর্ণিত দু-একটি ঘটনা ছাড়া। তবে আল্লাহ’তায়ালা কুরআন শরীফে বলেছেন “তিনি মৃত্যু দিয়েও আবার জীবিত করেছেন” (সূরা বাকারা ২৪৩; ২৫৯)। সেই মানুষগুলোর রূহগুলো কবচ করে ‘ইল্লীয়্যন’ ও ‘সিজ্জিয়্যন’ সম্ভবত নিয়ে যাওয়া হয়নি। Death trance এর মত অবস্থায় এরা ছিল। কারণ জীবন দানের পর তারা উত্তর দিয়েছিল ‘একদিন মাত্র ঘুমিয়ে ছিলাম’। যদি পরকালীন জীবনে চলে গিয়ে রূহ আল্লাহ কর্তৃক পুণরায় কবরে ফিরে এসে কবরের ফেরেশতাদের জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদেরকে পৃথিবীতে পুণরায় প্রেরণ করা হলে তারা সেসবের বর্ণনা দিত যা তারা কখনও দেননি।

রূহ্ কবচ কি?

যে প্রক্রিয়াতে এটা মানবদেহে আল্লাহর হুকুম হিসেবে সঞ্চারিত হয়েছিল প্রথমে মস্তিষ্কে তার পর অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ঠিক তার বিপরীত প্রক্রিয়ায় এটা বেরিয়ে আসবে অর্থাৎ ছড়িয়ে থাকার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে এবং সবশেষে মস্তিষ্ক থেকে। মূল ‘রূহ্’ বা মানবাত্মাটি যেটা স্রষ্টার কাছে চলে যাবে সেটা বেরিয়ে যাওয়ার পরও জড়দেহটির কিছু কিছু কোষ জীবিত থাকে তাকে জীবাত্মা বলে। তখনও জীবাত্মা নিঃশেষ হয়ে যায় না। Molecular death (সকল জীবিত কোষের মৃত্যু) হলে জীবাত্মাটি সম্পূর্ণরূপে বিনাশ হয়। কিন্তু মানবাত্মার কখনও বিনাশ হয় না। অন্য কোন দেহের অঙ্গে জুড়ে দিলে তা সচলও থাকতে পারে তবে প্রকৃত অর্থে পূর্বের ব্যক্তির মানবত্মাটি এই অঙ্গটিতে থাকে না (Medical science-এ অঙ্গ প্রতিস্থাপন : organ transplantation – জীবিত কোষ বিশিষ্ট অঙ্গকে Transplant গ্রহণকারীর দেহে প্রতিস্থাপন করলে ঐ অঙ্গটি জীবাত্মার সাথে যুক্ত হয়ে কার্যক্রম চালাতে থাকে)। প্রকৃতপক্ষে মানবাত্মা একটি আলো বা প্রচ্ছায়া স্বরূপ যা মৃত ব্যক্তির ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের মত তারা তাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসমূহ রক্ষা করে চলে।

রূহের যাত্রা বা মানবাত্মার যাত্রা

রূহটি মউতের ফেরেশতা কর্তৃক বের করে আনার পর অন্যান্য ফেরেশতারা সেটাকে নিয়ে আল্লাহর দরবারে হাজির করে। যদি পবিত্র আত্মা হয় তবে তার আমলনামা বেহেশতের কাছাকাছি ‘ইল্লীয়ন’ এ রাখা হয় এবং রুহটি মৃত ব্যক্তির কবরে প্রেরন করা হয়। কবর না থাকলে দেহাবশেষের কাছাকাছি অবস্থান নেয়। পূণ্যবান বান্দার কবরের সাথে বেহেশতের দরজার একটা যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হয় এবং এই অবস্থায় এই আত্মাটি কেয়ামতের শেষে পূনরুত্থান দিবস পর্যন্ত এভাবে অবস্থান করবে। পাপী ব্যক্তির আমলনামা রাখা হয় ‘সিজ্জিইনে’ এবং কবরে ঐ আত্মার সাথে দোযখের একটি যোগাযোগ থাকবে এবং তার কবর আযাবও চলতে থাকবে সেই কেয়ামত পরবর্তী পূনরুত্থান দিবস পর্যন্ত (সূত্রঃ রূহ্ কি? – আল্লামা হাফিজ ইবনে কাইয়াম (র), পৃঃ ৫৪-৫৬, রাসূল সাঃ এর হাদীস)।

বরযখ কি?

আসলে বরযখ হচ্ছে মৃত্যু পরবর্তী সময় থেকে কেয়ামত পর্যন্ত রূহের অবস্থান। অর্থাৎ জান কবচের পর থেকে কেয়ামত বা শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত রূহের চলাচল ও অবস্থান।

মৃত্যুর পর রূহ্’রা কি দেখতে পায়?

মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তির রূহ্ তার দেহাবয়ব, গোসল, দাফন-কাফন সব দেখতে ও শুনতে পায়। দেহের খাঁচার ভিতরে বন্দী থাকার কারনে তার দৃষ্টির অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। সে শুধু সামনের দিকে দেখতে পেত। এখন সে সামনে পেছনে, ডানে বামে, ঘরের ভিতর বাহিরে, নিজ কবরের মধ্যে ও বাইরে সবকিছুই দেখতে ও শুনতে পায়। তার আপনজন তার কবরের কাছে গেলে সে চিনতে পারে, সালাম দিলে তার জবাব দেয়, কুরআন তিলাওয়াত করলে খুশী হয়, সওয়াব বকশানো হলে তা থেকে উপকৃত হয় (সূত্রঃ উপরোক্ত পুস্তক পৃঃ ২৩-২৪)। জীবিতরা তাদের দেখতে পায় না কিন্তু রূহ্’রা জীবিতদের দেখতে পায়। তবে তারা আপনার বাড়ী ঘরে ঐ স্থান থেকে এসে ঘুরে বেড়ায় না। এপার ওপার মাঝে বন্ধন এতটুকুই। ‘প্ল্যানচেটে’ আত্মা বা প্রেতাত্মা নিয়ে আসা মূলত একধরনের চোখের ভেলকিবাজি অথবা শয়তানের সাধনা ছাড়া আর কিছুই নয়।

মৃত্যুর পর রূহের পূর্বে অর্জিত পুণ্যের ও পাপের কমবেশী হয় কি না?

মহান আল্লাহ’তায়ালা মৃত্যুর পর রূহের পুণ্য অর্জনের রাস্তা রেখে দিয়েছেন।

  • নেককার সন্তান-সন্ততি যারা তার জন্য দোয়া করে।
  • ‘সাদকায়ে জারিয়াহ’ যেমন এমনকিছু জ্ঞানদান যার সুফল যুগ-যুগান্তর মানুষ পেতে থাকবে। ভালকাজ, জনহিতকর কাজ, ভালশিক্ষা, ভাল নেতার পথ নির্দেশ ইত্যাদি।

তবে সবকথার সারকথা এই যে মৃত্যু পরবর্তী এই সওয়াবসমূহ কতটুকু মৃত বান্দার সওয়াবের পাল্লা ভারী করে তাকে জান্নাতের কোন স্তরে নিয়ে যাবে এটা বলা সম্ভব নয়। তবে এটা ঠিক যে জাহান্নাম থেকে জান্নাতে প্রবেশের মত সওয়াব এখান থেকে একজন সত্যিকার পাপী দোজখী বান্দা কখনও পাবে না তা সে যতই সৎকর্ম ও সাদকায়ে জারিয়াহ এর কাজ করে থাকুকনা কেন।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ

[প্রবন্ধটি আল্লামা হাফিজ ইবনে কাইয়াম (র) এর ‘রূহ্ কি’ বইটি ও লেখকের ব্যক্তিগত জ্ঞান ও পর্যবেক্ষণ থেকে রচিত।]

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top