ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী বলতে আমরা যা বুঝি তা হচ্ছে রাসুলুল্লাহর (সাঃ) জন্মদিন এবং সেজন্য খুশী বা আনন্দের প্রকাশ। বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ মুসলিম দেশে এই দিনটি সরকারী ছুটির দিন। আমাদের দেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বড় বড় নেতাদের জন্মদিন উপলক্ষ্যে বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবে ও বিশেষ উৎসাহ এবং উদ্দীপনার সাথে আনন্দানুষ্ঠান পালন করা হয়ে থাকে। সেসব অনুষ্ঠান করতে গিয়ে অনেক মুসলমানেরা অনেক ধরণের বাড়াবাড়ি করে ফেলে যা ইসলাম সমর্থন করে না (যেমন – হৈ-হুল্লোড়, নাচানাচি, গান-বাজনা, কেক কাটা, বিভিন্ন ধরণের সাজ পোশাক পরিধান, ব্যানার, ফেসটুন ইত্যাদি)। তথাপিও বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রে অহরহ এজাতীয় অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হচ্ছে। অথচ ইসলামের এই সীমালঙ্ঘনমূলক কাজের প্রতিবাদ আলেমদের কোন ফোরাম থেকে শোনা যায় না। আমাদের দেশেও এরূপ অনুষ্ঠানের কোনরকম মৌখিক সমালোচনাও কোন মহল থেকে শোনা যায় না বরং রাজনৈতিক পৃষ্টপোষকতায় এধরণের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ এখন সামাজিকতা রক্ষার পর্যায়ে চলে এসেছে।
নবী করীম (সাঃ) আরব ভূমিতে জন্মলাভ করলেও তিনি মূলতঃ সারাবিশ্বের মানুষের নবী বা বিশ্বনবী ও শেষ নবী হিসেবে আল্লাহ’তায়ালা কর্তৃক প্রেরিত হয়েছেন। খোদা প্রদত্ত ও তাঁর আধ্যাত্মিক দর্শন বা নূরে আলোকিত হয়েছে এই পৃথিবী। যারা এই আলোর সন্ধান লাভ করেছে তারা হয়েছে বিশ্বের সৌভাগ্যবান মুসলমান। এই মুসলিম জাতির প্রত্যক্ষ নেতা হচ্ছেন মহানবী (সাঃ)। তিনি তাদের শিক্ষা দিয়েছেন, ইসলামের জ্ঞান শিখিয়েছেন, কিভাবে আল্লাহর ইবাদত করতে হয়, কিভাবে আত্মিক পরিশুদ্ধিলাভ করে সমাজে আদর্শবান ও ভাল মানুষ হিসেবে অন্যের সাথে শান্তিতে বসবাস করা যায়। এরূপ একজন মহাপুরুষ, মহামানব, শ্রেষ্ঠ রাসূল, বিশ্বমানবতার কান্ডারী জন্মলাভ করেন আরবী মাসের ১২ই রবিউল আওয়াল রোজ সোমবার। সেকারণে সোমবার দিনটি অতি সম্মানের, মাসটিও অতি সম্মানের আর এই মাসের ১২ তারিখের সম্মান তো বলে শেষ করা যাবে না। ধন্য তুমি এই ১২ই রবিউল আওয়াল যেই নির্দিষ্ট দিনে আমাদের বিশ্বনবী মা আমেনার কোলে ভূমিষ্ট হয়েছিলেন স্বর্গীয় আশীর্বাদরূপে এই মানবজাতির প্রতি। তার আগমনে খুশী হয়েছিল সমস্ত ধরিত্রী, প্রকৃতি গাছপালা, আলো-বাতাস, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, তারা, বেহেশতের ফেরেশতারা। হুরেরা মা আমেনার সেবায় যেন নিমগ্ন হয়েছিল। এইরকমই আনন্দঘন ছিল আমাদের রাসুলুল্লাহর (সাঃ) বিশ্বে আগমণের এই ক্ষণটি।
তাই রাসুলুল্লাহর (সাঃ) জন্মদিনটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এইদিনে তার জন্ম উপলক্ষ্যে সভা, সেমিনার, শিক্ষণীয় অনুষ্ঠান, কবিতা আবৃতি, কিরআত, গান-গজল, হামদ্, নাত্, সুস্বাদু খাবার পরিবেশন, দোয়া-দরূদ মাহফিল অনুষ্ঠান করলে মুসলিম সংস্কৃতির বিকাশের একটি বড় রাস্তা তৈরী হবে। বিজাতীয় অপসংস্কৃতিতে আমাদের বর্হিমহল ও অন্দরমহল যেভাবে সংক্রমিত হচ্ছে তাতে ইসলাম শুধুমাত্র কিতাব, মসজিদ-মাদ্রাসার মধ্যে সীমাবদ্ধ হতে চলেছে, তার সামাজিক অবস্থান হারাতে বসেছে। এমতবস্থায় যেখানে যতটুকু ইসলামী অনুষ্ঠানের ও সংস্কৃতি চর্চার ফোরাম পাওয়া যায় তা কাজে লাগাতে হবে।
আমার মনে পড়ে ছোটবেলায় পাড়া-প্রতিবেশীরা মিলাদের দাওয়াত দিলে আমার বাবার হাত ধরে ঐ মিলাদে যেতাম। কখনও আব্বাজান না যেতে পারলে আমাকে একাই পাঠিয়ে দিতেন। আমার স্পষ্টভাবে মনে পড়ে আধুনিক পড়ালেখায় ব্যস্ত থাকলেও ঐসমস্ত মিলাদ অনুষ্ঠান থেকে যেসব ধর্মীয় কথাবার্তা, নবী-রাসুলদের ইতিহাস শুনতাম তা বাসায় ফিরে আব্বাজানের কাছে পুণরায় জিজ্ঞাসা করে জেনে নিতাম। এভাবে আমার প্রাথমিক ইসলামী জ্ঞান আহরণ হতো। আমার মত অনেকেরই এই একই অভিজ্ঞতা। কাজেই ঐ মিলাদ মাহফিল থেকে কোন কুশিক্ষা নিয়ে কেউ ঘরে ফিরেছে একথা কেউ বলবে না। এমনকি মিলাদে মিষ্টি বিতরণ কোন খারাপ জিনিস নয় সেটাও একটা আনন্দের পরিপূরক। কাজেই এই মিলাদ অনুষ্ঠান মুসলিম সংস্কৃতির একটি অত্যন্ত সুন্দর অংশ। বর্তমানে অন্দরমহলের মেয়েদের টিভি থেকে অপসংস্কৃতির কুশিক্ষা অর্জন ছাড়া কিছুই লাভ হয় না। না বুঝে শুধুমাত্র আক্ষরিক অর্থে মৌখিক কুরআন শরীফ শিক্ষা মনোজাগতিক ও চারিত্রিক পরিবর্তনে ও শিক্ষাদীক্ষায় তেমন কাজে আসে না। অন্দরমহলের মেয়েরা ইসলামী জ্ঞানের আদান-প্রদানে অন্যান্য মেয়েদের, প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে মেলামেশার কোন সুযোগই পায় না। এই মিলাদ মাহফিলের অনুষ্ঠান এক্ষেত্রে একটি বিশেষ সুন্দর ভুমিকা পালন করে। বছরে দুইবার মাত্র ঈদ অনুষ্ঠান হয়। তাতে আর কতটুকুই বা সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ হয়! কাজেই এই দুই ঈদ ছাড়া বৎসরে মাঝে মাঝে বিভিন্ন জন্ম-মৃত্যু ইত্যাদি অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে যদি প্রকৃতপক্ষে একটি সুন্দর আলোচনাভিত্তিক মিলাদ মাহফিলের অনুষ্ঠান করা যায় তবে সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ ও ধর্মীয় জ্ঞান প্রচার ও শিক্ষালাভে তা খানিকটা ভুমিকা রাখতে পারে।
শোনা যায় আমাদের দেশের অনেক আলেম নাকি ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী পালনে নিরুৎসাহিত করছেন এই অযুহাতে যে এটা ‘বিদাত’। ‘বিদাত’ অর্থ সওয়াবের আশায় নবীকরীমের (সাঃ) পরবর্তীতে কোন কাজ করা বা অনুষ্ঠান পালন করা। তাদের কথাই যদি ধরি তবে আমরা মনে করি ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী পালন আমরা সওয়াবের আশায় করছি না। অনেক ভাল কাজই তো সওয়াবের জন্য করা হয় না (যেমন – শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসায় ছাত্ররা পড়াশোনা করে কি সওয়াবের আশায়? নিজের আত্মগঠন ও চরিত্র গঠনই এখানে প্রধান লক্ষ্য)। তদ্রুপ ইসলামী সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য যদি ইদ-ই-মিলাদুন্নবী পালন করা হয় বা মিলাদ মাহফিল করা হয় তাহলে তো ঐ আলেম সমাজের আপত্তি থাকার কথা নয়। তাদের বুঝতে হবে যে ছোটখাটো এসব বিষয় নিয়ে এত সোচ্চার হলে ইসলাম বিরোধীরা কেমন মুখ টিপে হাততালি দিয়ে হাসে সেখবর তারা রাখেন না। ইসলাম আজ মসজিদ ও মাদ্রাসার মধ্যে কোনঠাসা হয়ে পড়ছে। বেশীরভাগ আলেমদের সামাজিক মান-মর্যাদা আজ কিছুই নেই। সামান্য বেতনে মসজিদের ঈমাম, কিভাবে তারা দিনাতিপাত করে, পেটের ভাত জোগাড় করা কত কঠিন। তাদের বৌ-বাচ্চারাও তো ভাগ্যবান, অবস্থাসম্পন্ন তাত্ত্বিক বড় আলেমদের বৌ-বাচ্চাদের মতই মুখ চেয়ে থাকে যে স্বামী কতটুকু তাদের আবদার পূরণ করতে পারছে। কাজেই বিদাত বা বিদাত নয় এই নিয়ে কোন তর্কে লিপ্ত হওয়ার সময় এখন নয়। এইসমস্ত মূল্যহীন তর্ক কোন কাজে তো আসবেই না বরং সাধারণ আলেমদের যতটুকু সামাজিক অবস্থান আছে তাও খর্ব করবে। এই ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী অথবা যে কোন মিলাদ মাহফিলে আলেমরাই প্রধান বক্তা হন। এজন্য তারা কিছু সম্মানীও পেয়ে থাকেন। তার জীবনধারণের জন্য সেটারও প্রয়োজন আছে। এটা অস্বীকার করার উপায় নাই।
কাজেই আমি মনে করি সাধারণ মুসলিম সমাজ ও আলেম সমাজ সমদ্বিহারে আনুষ্ঠানিকভাবে যার পক্ষে যতটুকু সম্ভব ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী পালন করা উচিত। এতে আমাদের সওয়াব হাসিলের কোন নিয়ত নাই। নবী করীমের (সাঃ) শ্রেষ্ঠত্ব সমাজের মাঝে তুলে ধরাই এসব অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য। সওয়াব দেওয়া বা না দেওয়ার মালিক তো আল্লাহ’তায়ালা। সে ব্যপারে আমাদের কি করার আছে? আল্লাহ আমাদের নিয়তকে কবুল করুন এবং সৎ উদ্দেশ্যে এসব অনুষ্ঠানাদি পালন করার তৌফিক দিন। আমীন।।