“বসো বেটা, মিষ্টি খেয়ে যাও”। এই কথাটি পঞ্চাশ বছর পর আজও আমার মনে পড়ে। দশ বৎসর বয়সে আমার শ্রদ্ধেয় আব্বাজানের সঙ্গে সেই সময়কার একজন মুদীর দোকানদার চাচার দোকানে গিয়ে তার এই কথা শুনেছিলাম। ছোটবেলার মিষ্টি খাওয়া বেশ আনন্দেরই ছিল। মনে পড়ে সেদিন ঐ চাচার দোকানটা লাল, সবুজ, নীল কাগজ দিয়ে বেশ সাজানো ছিল। ফিরবার পথে আব্বাকে জিজ্ঞাসা করলাম ঐ দোকানের সাজসজ্জা ও মিষ্টিমুখ করার হেতুটি। আব্বাজান বলেছিলেন “বাবা আজ পহেলা বৈশাখ, হালখাতা। এই দিন দোকানের পুরোনা খাতা বাদ দিয়ে নতুন খাতা খোলা হয়”। সেই বয়সে এর চেয়ে বেশী বুঝার কিছু ছিলনা, চেষ্টাও করিনি। ক্রমে ক্রমে বড় হয়ে বুঝতে পারি হালখাতা ও নববর্ষ সম্পর্কে।
নববর্ষ সেসময় আজকের মত ধুমধাম করে চাকচিক্যময় সাজে পালন করা হত না। বাজারে গেলে দেখা যেত দু-চারটি দোকানে কিছু কিছু গান-বাজনা, রেডিওর গান ও লোকজনের সমাগম ও সেইসাথে হাতে হাত মেলানো ও মিষ্টিমুখ করার দৃশ্য এবং ব্যবসায়ীদেরও তাদের পুরাতন ধার-বাকীর হিসাব নিকাশের খাতার পরিবর্তে নতুন খাতা তৈরীর কাজ।
এখন অতি পরিপক্ক বয়সে এসে এই নিয়ে নতুন করে ভাবছি।
বাংলা নববর্ষ আমাদেরকে মুঘল সম্রাট আকবরের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। চান্দ্র মাস যেহেতু সৌরমাসের চাইতে বৎসরে দশ দিন কম এবং সেজন্য বার্ষিক ঋতুসমূহ সৌরমাসের সাথে আবর্তিত হলেও চান্দ্রমাসের সাথে মিলে না। চন্দ্র মাসের তারিখ অনুযায়ী প্রজাদের খাজনা আদায় করা তাই কঠিন হয়ে পড়তো। চান্দ্র মাস অনুসারে অভাবের মধ্যেও কখনও কখনও প্রজাদের বার্ষিক খাজনা দিতে হত। সেজন্য সম্রাট আকবর বৎসরের একটি নির্দিষ্ট দিনে এই খাজনা আদায়ের ব্যবস্থা করেন। তিনি তার অধীনস্থ বিশিষ্ট জ্যোতির্বিদ ও বিজ্ঞানী ফতুল্লাহ সিরাজীকে নির্দেশ দেন। ফতুল্লাহ অনেক চিন্তাভাবনা করে বাংলা সালের ১লা তারিখ (পহেলা বৈশাখ) দিনটি ধার্য্য করেন যা বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রথম দিন। তখন থেকেই ১লা (পহেলা) বৈশাখ বাংলা নববর্ষ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তারপর থেকে হালখাতা অর্থাৎ নতুন খাতার প্রচলন করাটা বৎসরের শুরুতেই চালু হয়ে যায়। এদেশের ব্যবসায়ী ও দোকানদারদের মধ্যে ক্রমে ক্রমে এবং পরবর্তীতে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলায় এই নববর্ষ পালন ক্রমবিকাশ লাভ করে।
কবিগুরু রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর নববর্ষ উপলক্ষে আলাদা গান রচনা করেননি তবে তার রচিত বৈশাখের একটা জনপ্রিয় গান বাংলা নববর্ষের প্রধান সংগীত হিসেবে পরিণত হয় যা আমরা সবাই জানি এবং তার প্রথম পংক্তি হচ্ছে “এসো হে বৈশাখ, এসো এসো . . . . . . ”। এর সাথে কালক্রমে যুক্ত হয় পিঠাপুলি, মিষ্টি খাওয়া, গান গাওয়া। কিন্তু পরবর্তীকালে হালখাতার প্রথা ধীরে ধীরে অপসৃত হতে লাগল। এই স্থান দখল করল মিষ্টির পরিবর্তে পান্তা ও তার সাথে যুক্ত হল ইলিশ অর্থাৎ পান্তা-ইলিশ যা এখন এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে অস্বাস্থকর হলেও ঘটা করে পান্তা-ইলিশ না খেলে যেন নববর্ষের চেতনার বরখেলাপ হয়ে গেল। এখন আরও যুক্ত হয়েছে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, রং মাখা, বিভিন্ন সাজ পোশাকে সজ্জিত হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো, গান গাওয়া। জাতীয়ভাবেও বর্তমানে আমাদের দেশে নববর্ষ সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় পালিত হচ্ছে। গ্রামে গঞ্জে খেলাধূলা, নৌকাবাইচ, বৈশাখী মেলা, কুস্তি, লাঠিখেলা ইত্যাদিও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হয়ে থাকে। বৈশাখী মেলায় দোকানপাট সাজানো বিভিন্ন ধরণের হস্ত ও কুটিরশিল্পের বিজ্ঞাপন, শিশুদের আনন্দ দানের জন্য নাগরদোলা, সকলের জন্য ছোট-বড় খেলাধূলা, বাঁশি, লটারীতে অংশগ্রহন ইত্যাদি।
ঢাকার রমনার বটমূলের ছায়ানটের সঙ্গীত পরিবেশনার অনুষ্ঠানটি ১৯৬৭ সাল থেকে চালু আছে। ১৯৮৯ সালে যুক্ত হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা যা এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ থেকে শুরু হয়ে এই শোভাযাত্রাটি ঢাকার বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে থাকে। তাতে আবহমান বাংলাকে ফুটিয়ে তোলা হয়। সকল শ্রেণীর মানুষ এতে অংশগ্রহণ করে। বানানো হয় বিভিন্ন ধরণের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি। এখন কোথায় হারিয়ে গেছে আমার চাচাজানের সেইকালের হালখাতা প্রথা ও নির্মল, হৈ চৈ হীন মিষ্টির আনন্দ।
পহেলা বৈশাখের এই বর্ষবরণ এখন বাঙ্গালীর জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। সকল স্তরের মানুষ এখন এটাতে অংশগ্রহন করে ও আনন্দলাভ করে। UNESCO ২০১৬ সালে এই উৎসবকে বাঙ্গালীর জাতীয় উৎসব হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে যেমন তারা বহুপূর্বে স্বীকৃতি দিয়েছে ইরানে প্রচলিত নববর্ষের জাতীয় উৎসব নওরোজ প্রথাকে। ইরানীরা যেভাবে উৎসাহের সাথে এই বর্ষবরণ করে এবং বাড়িঘর নতুন করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও রং করে, আসবাবপত্র নতুন করে সাজায়, আত্মীয় ও বন্ধুদের সাথে ঘোরাঘুরি ও শোরগোল করে উৎসবটি পালন করে সেভাবে এখনও আমাদের দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ঠিক ততখানি আবেগ অনুভুতি এই পহেলা বৈশাখ উৎসবকে ঘিরে লক্ষ্য করা যায় না। বরং একশ্রেণীর মানুষ এই দেশে এই উৎসব পালনে নানাভাবে বিরোধীতা করে। বিরোধীতার কারণ হিসেবে তারা কিছু কিছু যুবক যুবতীদের উৎসবের নামে কিছু অশ্লীলতা ও অশালীন চলাচলকে দায়ী করে থাকেন। একথা ঠিক যে জাতি হিসেবে আমাদের একটা নিজস্ব মূল্যবোধ আছে যা পাশ্চাত্য সংস্কৃতি তেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ধর্মীয় দৃষ্টিকোন ছাড়াও আমাদের দেশের সর্বস্তরের মানুষ সমর্থন করেনা। এছাড়াও এর ফলে ইভটিজিং, অবৈধ কাজকর্ম ও তার প্রতিবাদে ভায়োলেন্সের জন্ম নেয় এবং যা রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ঘটনা ঘটার পর সেটার সুরাহা করার চাইতে ঘটনার প্রেক্ষাপট তৈরী হতে না দেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ। সেদিকেই সবাইকে নজর দিতে হবে।
আমাদের দেশে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের উচিত নিজ নিজ ক্ষেত্র থেকে এই জাতীয় উৎসব তাদের মন মেজাজ অনুসারে পালন করা। একে দূরে ঠেলে না দেওয়া। এর ফলে দেখা যাবে তাদেরই ছেলে-মেয়ে, ভাই-ভাতিজা অপসংস্কৃতির স্রােতে ভেসে যাচ্ছে। শুধুমাত্র বিরোধীতা করে এই জাতীয় উৎসবের দিবসটিকে অপসংস্কৃতির স্রােতের নিয়েন্ত্রণে ছেড়ে দিয়ে জাতিয় মূল্যবোধকে নষ্ট হতে দেওয়া উচিত নয়।