কুরবানীর তাৎপর্য ও শিক্ষা

Eid ul Azha

কুরবানী কি?

কুরবানীর আভিধানিক অর্থ অতিশয় নিকটবর্তী হওয়া। পারিভাষিক অর্থে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নির্দিৃষ্ট দিনে পশু জবেহ করার নাম কুরবানী। প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর উপর যাদের পারিবারিক সমস্ত ব্যয় নির্বাহের পরও উদ্ধৃত টাকা থাকে কুরবানীর পশু ক্রয়ের মত তার উপর কুরবানী ওয়াজিব হবে (সূরা হজ্জ; আয়াত ৩৪)।

পশু হত্যা নয়

ঈদ একটি আনন্দদায়ক মুসলিম উৎসব। তাহলে স্থুল দৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে এটি পশু হত্যার মাধ্যমে আনন্দ উৎসব। বৌদ্ধধর্ম বলে, জীব হত্যা মহাপাপ। আমরা মুসলমানরা মনে করি প্রয়োজন ছাড়া কোন জীবকে হত্যা করা উচিত নয় এমনকি একটা গাছ বা আগাছাকেও। কেননা সেও আল্লাহর সৃষ্টি এবং তারাও আল্লাহর গুনগান করে। তখন প্রশ্ন জাগে কেন এই হত্যা? তবে কি হত্যার উদ্দেশ্য কি পশুগুলোর গোশত খাওয়া? একজন বোকাও একথা বলবে না যে শুধুমাত্র গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্যে কোন ধর্মে একসাথে এতগুলো পশু হত্যার নির্দেশ থাকতে পারে। সেটা বুঝতে হলে কুরবানীর মমার্থ, তাৎপর্য ও ইতিহাস বুঝতে হবে।

কেন এই পশু কুরবানী করা আল্লাহর কাছে এত প্রিয় হল? বাহ্যিক এই নিষ্ঠুর কাজ শেষ পর্যন্ত কেন আল্লাহর এত প্রিয় হল? তাহলে মহান স্রষ্টা কি নিজ সৃষ্টির প্রতি এত নির্দয়? এটা কি কখনও হতে পারে?

কুরবানীর ইতিহাস

এই কুরবানীর পিছনে একটা খুবই চিত্তাকর্ষক ও হৃদয় আলোড়ন সৃষ্টিকারী ইতিহাস জড়িত আছে। স্রষ্টার ভালবাসাই যে সবচাইতে বড় পাওয়া তার নেক বান্দাদের জন্য এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কিছুই হতে পারে না হযরত ইব্রাহিম (আঃ) তার প্রমান দিয়ে গেছেন। যখন তিনি স্বপ্নে আদিষ্ট হলেন তার সবচাইতে প্রিয়তম বস্তুকে আল্লাহর ওয়াস্তে জবেহ করার জন্য তখন তিনি তা বুঝতে পারলেন। তিনি শিশুপুত্র ঈসমাইলকে ব্যাপারটা জানালেন। পুত্র ঈসমাইল তার শেষ বয়সে প্রাপ্ত অত্যন্ত আদরের সন্তান ছিলেন। কিন্তু নিজ পালন কর্তার আদেশতো তিনি নবী হিসেবে ফেলতে পারবেন না। শিশুপুত্র হলেও ঈসমাইল ঘটনাটি শুনার সাথে সাথে বললেন “পিতা আপনি আল্লাহর আদেশ পালন করুন নিশ্চয় আমাকে ধৈর্য্যশীলদের মধ্যে পাবেন” (সূরা সাফ্ফাত; আয়াত ১০২)। অর্থাৎ তিনি এতে কোন মনক্ষুন্ন বা মনোঃকষ্টে ভুগবেন না বলে জানিয়ে দিলেন।

ইব্রাহিম (আঃ) পুত্র ঈসমাইলকে নিয়ে মক্কার অদূরে মিনা নামক প্রান্তরে নিয়ে গেলেন। যাবার পথে শয়তান কর্তৃক একবার নয়, দু-বার নয়, তিন তিনবার ধোঁকাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। তিনি কিন্তু নিজ সিদ্ধান্তে অর্থাৎ আল্লাহর সিদ্ধান্তে অটলস্থির ছিলেন। যথাস্থানে পৌছে তিনি ঈসমাইলকে মাটিতে শুইয়ে দিলেন। ঈসমাইল অত্যন্ত শান্ত ও ধীরস্থিরভাবে আল্লাহর ইচ্ছা পালনে পিতাকে সহায়তার জন্য দৃঢ়চিত্তে অপেক্ষা করতে লাগলেন। নবী পিতার নবী সন্তানতো এরূপ হওয়ারই কথা (হযরত ঈসমাইল আঃ পরে নবী হয়েছিলেন)।

যা হোক, জবেহর জন্য অস্ত্র নিয়ে যখন তিনি আল্লাহু আকবার বলে এক ‘ফ্যাস’ হয়ত দিতে যাবেন বা দিয়েছেন। হয়ত নিজপুত্রের রক্ত নিজের চোখে সহ্য করতে পারবেন না মনে করে এক মূহুর্তের জন্য চোখ বন্ধ করেছিলেন। চোখ খুলে দেখলেন যে পাশে দাঁড়িয়ে পুত্র তার হাসছে এবং একটা দুম্বা (পশু) সেই স্থানে জবেহ হয়ে গিয়েছে। তিনি পরীক্ষায় সফল হয়েছেন। আল্লাহ পিতা-পুত্র উভয়কেই এই পরীক্ষায় জয়ী করে নিয়েছেন। তদস্থলে বেহেশতের একটা পশু কুরবানী হয়ে গিয়েছে।

আল-কোরআনে এই ঘটনার বিবরন অতি সংক্ষিপ্ত আকারে পাওয়া যায় (সূরা সাফ্ফাত; আয়াত ১০৩-১১০)। কারন অনেক গল্প ও ঘটনা তখনকার মানুষের মধ্যে প্রচলিত ছিল বলে আল্লাহতায়ালা গুরুত্ব বুঝানোর জন্য ঘটনার ইঙ্গিত করেছেন মাত্র। তফসীরকারকগণের বর্ণনায় এরূপ পাওয়া যায় যা পরিস্থিতির সত্যতার বিরুদ্ধ নয়। ঘটনা পরম্পরার ব্যাখা এরূপ হওয়াটাই স্বাভাবিক। সেজন্যই আমাদের মনে দাগ কাটে।

বেহেশতের পশু

জবেহকৃত ঐ পশুটি কিন্তু সাধারন পশু নয়। এটা অতি সম্মানিত বেহেশতের একটা পশু যা অন্যান্য পশুদের থেকে বিশেষভাবে আলাদা। এই পশুই পরকালের জন্য স্বাক্ষী হয়ে থাকবে যে ইব্রাহিম (আঃ) যথার্থই তাঁর শিশুপুত্রকে কুরবানী দিয়েছিলেন। শিশুপুত্রকে জড়িয়ে ধরে হয়ত ইব্রাহিম (আঃ) আনন্দাশ্রু বর্ষন করেছিলেন এবং জবেহকৃত ঐ বেহেশতি পশুটির দিকে তাকিয়ে পিতাপুত্র উভয় অবাক বিস্ময়ে আল্লাহর কুদরত অবলোকন করেছিলেন এবং হয়তো মনে মনে তার তসবীহ পাঠ করেছিলেন “হে আল্লাহ সকল প্রশংসা তোমার, তুমি আমাদেরকে তোমার রহমতের ছায়ায় আশ্রয় দান কর”।

এরূপ একটা তাৎপর্যপূর্ন পূণ্যময় খোদাভীতির প্রকৃষ্ট উদাহরন মুসলিম মনে জাগরুক রাখার জন্য আল্লাহর নির্দেশে সেই থেকে পৃথিবীর মুসলমানগন তথা উম্মতে মোহাম্মাদী এই ইবাদত পালন করে থাকে।

আমাদের কুরবানীর পশু

আমাদের জবেহকৃত পশুগুলোও মায়াময় সুন্দর বেহেশতের পশুগুলোরই অনুরূপ। এরাও অন্যান্য পশুর থেকে বিশেষভাবে সম্মানিত হয়ে থাকবে এবং পরকালে তার মনিবের (কুরবানীকারীর) পক্ষ থেকে আল্লাহর ওয়াস্তে স্বাক্ষী দিবে “হে আমার রব, তোমার এই বান্দাহ গোশত খাওয়ার জন্য আমাকে জবেহ করেনি, করেছে শুধু তোমার নির্দেশে তোমার ভালবাসায় তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য যেমন তোমার নবী ইব্রাহিম (আঃ) অনুরূপ একটা পশুকে তোমার উদ্দেশ্যে জবেহ দিয়েছিলেন। তুমি ইব্রাহিম (আঃ) এর নিয়তকে যেভাবে কবুল করে তাকে সফলতা দান করেছ তদ্রুপ এই বান্দাহকেও কবুল করে নিও”। বস্তুত কুরবানীর মহত্ব এখানেই।

সংশয়বাদীদের সন্দেহ

নিছক পশুহত্যা ও নির্মমতা বলে এটাকে আখ্যা তারাই দিতে পারে যারা আমাদের ধর্মের spirit এর কিছুই বোঝে না। তারাই অবিশ্বাসী ও সংশয়বাদী। আরও কিছু লোক আছে যাদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশী যারা এই কাজ যে কেন করতে হয় তা না বুঝেই অনুষ্ঠান পার্বনের মত নির্দি¦ধায় অবলীলাক্রমে করে যাচ্ছে অন্তরের ন্যূনতম অনুভূতি ছাড়াই।

কাজেই কুরবানীর গোশত খাওয়া না খাওয়া, বিতরন পদ্ধতি যেরূপ ধর্মীয় কিতাবসমূহে লেখা আছে তা Primary জিনিস নয়। সে সমস্ত হচ্ছে Secondary বিষয়সমূহ যথা- গোশতের কি হবে? চামড়ার কি হবে? ইত্যাদি সম্পর্কে বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে (হাদীস ও বেহেশতী জেওর দ্রষ্টব্য)। Primary জিনিস হচ্ছে কুরবানীর পূর্ববর্ণিত spirit ও তাকওয়া (সূরা হজ্জ; আয়াত ৩৭)।

মুসলিম ও অমুসলিম উভয় সংশয়বাদীদের দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে যে এরূপভাবে এত বিপুলসংখ্যক পশুকে একত্রে হত্যা করলে তো সেটা ক্রমশঃ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এটা ঠিক নয়। কারন, একটা জিনিস খেয়াল করার বিষয় যে একটা গরু, ছাগল, দুম্বা বছরে এক বা একাধিক বাচ্চা দেয়। কিন্তু একটা হিংস্র বাঘ/সিংহ ৭/৮টা করে বাচ্চা দেয় এবং সেগুলোকে তো কেও জবেহ করে না, খায়ও না। তাহলেতো ঐ পশু দিয়ে পৃথিবী ভরে যাওয়ার কথা ছিল। এটা কখনও হয়না কারন সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিতে দেখা যায় ঐসমস্ত হিংস্র পশুরা নিজের বাচ্চাদের ছোট অবস্থায় নিজেরাই মেরে ফেলে। সাপ বা কুমীর ডিম থেকে বাচ্চা বের হওয়ার পর পরই খেয়ে ফেলে। এভাবে আল্লাহতায়ালা প্রকৃতির স্রষ্টা, প্রকৃতির ভারসাম্য কিভাবে রক্ষিত হতে পারে তিনি তাও জানেন। এজন্য হালাল পশুর অভাবে কখনও কুরবানী বন্ধ অতীতে হয়নি ভবিষ্যতেও হবে না একথা নিশ্চিতভাবে সংশয়বাদীদের জবাবে বলা যায়।

অন্যান্য উপকার

এই কুরবানীর পার্শ্বপ্রতিক্রয়া হিসাবে চামড়ার ব্যবসার উপর জীবিকা নির্বাহী কিছু ব্যবসায়ী শ্রেনী সৃষ্টি হয়েছে যারা এ থেকে আয় রোজগার করে। এটা কোন খারাপ কিছু নয়। পশুর চামড়া বিক্রির টাকা সম্পূর্নরূপে মিসকিনদের হক। এই মওসুমে বিভিন্ন লিল্লাহ বোর্ডিংসহ প্রভৃতি স্থানে এই চামড়ার টাকা দান করা যায় তাতে এই সমস্ত গরীব এতিম অসহায় শিশুদের আহারের সংস্থান হয় যেটা একটা ভাল দিক। অন্যান্য মিসকিনরা এই টাকা থেকে উপকৃত হয়।

কুরবানীর শিক্ষা

১. নিজের শ্রেষ্ঠ জিনিস শ্রেষ্ট সময় পালনকর্তার নির্দেশ মাফিক অকাতরে কুরবানী করতে হবে এবং বলতে হবে “ইন্নাস সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহ্ওয়াইয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন” (নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার কুরবানী ও আমার জীবন মরন বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহ রাব্বুল আল-আমীনের জন্য, সূরা আন’আম;১৬২)। এটাই একজন মুমীনের একমাত্র চাওয়া ও পাওয়া।

২. কুরবানীর গোশত আল্লাহর কাছে পৌছায় না, পৌছায় বান্দার নিয়ত ও তাকওয়া।

৩. কুরবানী কোন দুঃখের বিষয় নয়। এটা ইব্রাহিম (আঃ) এর সন্তান কুরবানীর অনুরূপ স্রষ্টার তরফ থেকে পরীক্ষায় পাসের আনন্দের জিনিস। এজন্যই এটাকে ঈদ-উল-আযহা অর্থাৎ উৎসর্গের উৎসব বলা হয়।

৪. কবি নজরুলের ভাষায় “ওরে হত্যা নয়, আজ সত্যগ্রহ, শক্তির উদ্বোধন”। কাজেই বিরোধীপক্ষের প্রচার প্রপাগন্ডায় নিজ মনকে দূর্বল না করে প্রকৃত spirit বুঝতে পারলে মন আরো সতেজ হবে এবং ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হবে। আমীন।।।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top