আলো ও আল্লাহর নূর
আল্লাহ’তায়ালার নূর বা জ্যোতি সকল শক্তির উৎস। ফেরেশতারা আল্লাহর সৃষ্ট নূরের তৈরি। নূর ও আলো একই জিনিস নয়, একটু আলাদা যদিও আল্লাহর নূরকে Light of Allah বলা হয়। তবে আল্লাহর নূরের প্রকৃতি কেমন তার সরাসরি ব্যাখ্যাদান সম্ভব নয়। বিভিন্ন উপমা থেকে যা ধারণা করা হয় তা হচ্ছে আল্লাহর শক্তি সকল প্রকৃতিক শক্তি ও বস্তুর উর্ধ্বে এবং গতিময়তার দিকে থেকে অসীম। আল্লাহর নূরের ব্যাপ্তিও অসীম এবং সেই নূরের সাথে আছে আল্লাহ’তায়ালার রূহ্ যা সকল প্রকার জীবনী শক্তির উৎস। অসীম শক্তির অধিকারী বিধায় পৃথিবী, আকাশ, বাতাস, গ্রহ, নক্ষত্র, সূর্য, চন্দ্র, নীহারিকাপুঞ্জ সকলেই তাঁর অধীন এবং তাঁর হুকুমমত চলে।
এই নূরের তাজাল্লী এত তীব্র যে হযরত মূসার (আঃ) সম্মুখে পাহাড়টি নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল (সূরা আল-আরাফ; আয়াত ১৪৩)। মুসলিম শরীফের হাদীসে আছে যে পৃথিবীর দৃশ্যমান ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আলোকশক্তি আল্লাহর নূরের পর্দা মাত্র। এই পর্দা সরে গেলে আল্লাহর নূরের প্রখরতায় সম্মুখে সৃষ্ট সকল বস্তু ভষ্মীভূত ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত।
কাজেই আলো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হলেও আল্লাহর নূর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। মনের অনুভূতি দিয়ে তাঁকে কল্পনা করা ছাড়া পৃথিবীর মানুষের অন্য কোন উপায় নেই। আবিস্কৃত আলোর গতি বা বৈদ্যুতিক গতি সর্বোচ্চ গতি নয়। বর্তমানে বিজ্ঞানে আলোর গতির চাইতেও কয়েকগুন বেশী গতিশীল শক্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। যেমন- cosmic rays এর গতি (সৌরজগতের বাইরে নক্ষত্রের রেডিয়েশনের রশ্মি)।
আল্লাহতায়ালার বিশালত্ব আমাদের কল্পনারও অতীত। তবে একথা ঠিক যে শক্তিময়তার দিকে থেকে তিনি এতই অসীম যে উর্ধ্বে গ্রহ, নক্ষত্র, সূর্য, আকাশ, নীহারিকাপুঞ্জসমূহের তাঁর নির্দেশের বাইরে চলার ক্ষমতা নেই। তেমনিভাবে নিম্নে সুক্ষাতিসুক্ষ্ম ইলেকট্রন, প্রোটন, ফোটন কোন কিছুই তাঁর সৃষ্টিকালে নির্দেশিত নিয়ম নীতি ভঙ্গ করার ক্ষমতা নেই। সবকিছুই তাঁর নির্ধারিত নিয়মে পরিচালিত হচ্ছে (সূরা ইয়াসিন; আয়াত ৩৮-৪০)।
আল্লাহতায়ালার সৃষ্ট নিয়মে চলা
আল্লাহ’তায়ালা এমনই এক মহাসত্তা যা বর্হিজাগতিক ও জাগতিক নির্জীব বস্তু নিচয় সৃষ্টি করেই খান্ত হননি। তিনি সত্তাসম্পন্ন ‘মাখলুকাত’ সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টির পর থেকেই অজৈব সমস্ত সৃষ্ট বস্তু যেমন তাঁর নির্ধারিত নিয়ম মেনে চলে এবং আবর্তিত হয় (একেই পাশ্চাত্য বিজ্ঞানীরা প্রকৃতিক নিয়ম বলে থাকেন) তেমনিভাবে সৃষ্ট জীবও একটা নির্দিৃষ্ট ধারায় সৃষ্টির পর থেকে একটা নির্দিৃষ্ট জীবনচক্র নিয়ে চলতে থাকে, আবর্তিত ও বিবর্তিত হয় (এটাকে বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন প্রাকৃতিক বিবর্তন)। এই নিয়মসমূহের ব্যতয় কিন্তু লক্ষ্য করা যায় না। কোন একসময় মহান স্রষ্টার ইচ্ছায় সৃষ্টি হলো বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন কিছু স্বাধীন সত্তার। আমাদের জ্ঞানের পরিসীমার মধ্যে এরূপ দুটি স্বাধীন সত্তা সম্পর্কে জানা আছে। একটি হচ্ছে জ্বীন জাতি অপরটি হচ্ছে মানব জাতি। এর বাইরে সৃষ্টি জগতে এরূপ অন্যকোন প্রাণের অস্তিত্ব আছে কিনা আল্লাহ’তায়ালা কোথাও স্পষ্ট করে বলেননি তবে নাই সে কথাও বলেননি। কাজেই মহাজাগতিক বিশ্বচরাচরে তা থাকতেও পারে সেটা তাঁর সৃষ্টি লীলারই অংশ।
আগুন, আলো, মাটি ও পানি
আগুন হচ্ছে বস্তুর দহনের মাধ্যমে সৃষ্ট তিনটি জিনিসের সমন্বয় (ধোঁয়া, আলো ও তাপ)। বস্তুতে অক্সিজেন যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে এটা ঘটে থাকে। এরূপ আগুন থেকে আল্লাহর ইচ্ছায় জীবনিশক্তির সঞ্চারের মাধ্যমে জ্বীন জাতির জন্ম (সূরা আর-রহমান; আয়াত ১৫)।
মাটি ও পানি প্রকৃতিতে অন্যান্য জিনিসের তুলনায় অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা। এই ঠান্ডা বস্তুকে একটা নির্দিৃষ্ট আকৃতিতে নিয়ে এসে রূহের সঞ্চার করে আল্লাহ’তায়ালা প্রথম মানব সৃষ্টি করেছিলেন (সূরা আর-রহমান; আয়াত ১৪)।
রসায়ন বিজ্ঞান সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তাদের জানা আছে পানি কিভাবে সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ’তায়ালা। দুটি গ্যাস হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন যথাক্রমে দুইভাগ ও একভাগ সংমিশ্রণের মাধ্যমে পানি তৈরী হয়েছে। সংমিশ্রণের পর এই গ্যাসদ্বয়ের ভৌত পরিবর্তন অর্থাৎ পানিতে রুপান্তর বিষ্ময়কর। কারণ, হাইড্রোজেন একটি দাহ্য গ্যাস এবং অক্সিজেন এমন একটি গ্যাস যা কোন কিছু জলতে সাহায্য করে। কিন্তু এই দুটি মৌলিক পদার্থের বিক্রিয়ায় এমন একটি পদার্থ তৈরী হয় যা তরল এবং তা আগুন নিভাতে সাহায্য করে। এক্ষেত্রে মৌলিক পদার্থ দুটির নিউক্লিয়াসে কোন পরিবর্তন হয় না। শুধুমাত্র বাইরের ইলেকট্রনের পরিবর্তনের ফলে এত ব্যাপক ভৌত পরিবর্তন সূচিত হয়।
কাজেই সৃষ্টিকর্তার পক্ষে পানি ও মাটি সৃষ্টি করা মোটেই কঠিন ব্যপার নয় এবং তা থেকে মানুষের অবয়ব সৃষ্টি করে তার রূহ থেকে ফুৎকার দান এমনকিছু কষ্টসাধ্য নয় যেহেতু তিনি অসীম জ্যেতির্ময় একটি সত্তা।
স্রষ্টার নূর ইহজগতে অপ্রকাশ্য
স্রষ্টার নূরের তাজাল্লী অসীম প্রখর হলেও তার পাশাপাশি সেটা স্নিগ্ধ, বরকতময় এবং জ্যোতির্ময়ও। কিন্তু তিনি সেটা সৃষ্টির বিনাশ না হওয়ার স্বার্থে প্রকাশ করেন না। এখানেই মহান আল্লাহর শ্রেষ্টত্ব্য ও বৈশিষ্ঠ্য লুকায়িত আছে। অসীম শক্তির আধার হয়েও তিনি প্রকাশিত নন। ধরা ছোঁয়ার বাইরে অবস্থান করে সমগ্র সৃষ্টিলোক পরিচালনা করছেন।
শ্রেষ্ঠতম পক্ষপাতহীন বিচারক
তিনি যেহেতু সমস্ত সৃষ্টিকূলের মালিক কাজেই কারো প্রতি বৈরীভাব বা পক্ষপাত তাঁর নেই। তিনি সেকারনেই ন্যয়বিচারক। যতপ্রকার সুন্দরের প্রতীক পৃথিবীতে অসুন্দর আমাদের দৃষ্টিতে থাকতে পারে কিন্তু তাঁর দৃষ্টিতে নেই। আমরা নিরপেক্ষ হতে পারি না কিন্তু তিনি বস্তু নিরপেক্ষ। তিনি সুন্দর ও স্নিগ্ধ। তিনি যাবতীয় পাশবিকতা, অসুন্দরতার উর্ধ্বে এবং পঞ্চ ইন্দ্রিয়হীন। সকল প্রকার পাপাচার ও পূর্ণ করার হাতিয়ার আমাদের এই ইন্দ্রিয়। আল্লাহ’তায়ালা ইন্দ্রিয়সম্পন্ন নন। তাঁর কোন পাপ পুণ্য নেই। তাঁর সবই পুণ্য ও সুন্দর। সমস্ত সৃষ্টিলোক তাঁর অধীন। তাঁর কোন সমকক্ষ নেই (সূরা ইখলাস; আয়াত ১-৩)। তিনি কিভাবে আবির্ভূত হলেন এই প্রশ্নের উর্ধ্বে তিনি। সারা পৃথিবী জুড়ে চিন্তাবিদ ও বৈজ্ঞানিকগণ যুগে যুগে একত্রে লব্ধ জ্ঞানেরও কোন সাধ্য নাই এই রহস্য খুঁজে বের করার। বরং হতাশার একপর্যায়ে বিভ্রান্তিতে পড়ে তাঁকে অস্বীকার করে পথভ্রষ্টতার স্বীকার হবে।
স্রষ্টার নির্দেশিত পথ
তাঁর পথ তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন তাঁর মনোনীত বান্দাদের মাধ্যমে তাঁর ‘ওহী’ বা ‘প্রত্যাদেশ’ দ্বারা (সূরা হাদীদ; আয়াত ২৫)। ঐ প্রত্যাদেশে কোন ভ্রান্তি আছে কিনা বা ঐ প্রত্যাদেশসমূহ সঠিক আছে কিনা তা যাচাই-বাছাই করা যেতে পারে। তাতে যদি কোন প্রকার ভ্রান্তি না পাওয়া যায় তবে অলীক কল্পনা করে তাকে অস্বীকার করার অর্থ হচ্ছে ‘কুফরী’ করা। এই অস্বীকারকারীরা পৃথিবীর জ্ঞানে যতই পারঙ্গম মনে হোকনা কেন, যতই জ্ঞানী মনে হোকনা কেন তারা প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানী নয়। স্রষ্টাকে চিনতে পারাটাই সকল জ্ঞানের মূল।
আল্লাহর দীদারলাভঃ নেককারদের জন্য পরকালে
পুণ্যবান ব্যক্তিরা যারা আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভ করতে এবং তাঁর পথে চলবে তাদের দোষ-ত্রুটি দূর করে তাদের রূহকে পবিত্র করে তিনি এমন নূরে রুপান্তরিত করবেন যেন পরকালে আল্লাহর দীদারলাভে সমর্থ হয়। অর্থাৎ আল্লাহর নূরের তাজাল্লী সহ্য করার ক্ষমতা অর্জন করে। অপরপক্ষে পাপীদের রূহ পবিত্র হতে পারবেনা। তাদের ঐ রূহে কালিমা পড়তে পড়তে তা কালিমাময় স্থুল ও অনুজ্বল হবে আল্লাহর নূরে কাছে পৌছাতে পারবেনা বরং ঐ রূহকে তার কৃতকর্মের জন্য পরকালে শাস্তি পেতে থাকতে হবে অনন্তকাল (আল্লাহ অন্য কিছু চাইলে ভিন্ন কথা)।
রূহ একটা সত্তা বিশেষ। তাকে শাস্তি দিতে হলে তাকে অবশ্যই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপ দিতে হবে। সেকারনে ঐ রূহ বিশিষ্ট মানুষকে পূনরায় পৃথিবীর মত পরিপূর্ন শারীরীক মানবরূপে আল্লাহতায়ালা সৃষ্টি করে তাকে শাস্তি দিবেন। এই কঠোর শাস্তিসমূহের কারনে তার মৃত্যু হলে পূনরায় তাকে জীবিত করে পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রকার অকর্ম কুকর্মের বিপরীত staging-এ শাস্তি চলতে থাকবে। প্রকৃত ন্যয়বিচার করতে হলে শাস্তির প্রকৃতি এরকমই। শুধু আগুনে পোড়ানো ছাড়াও তা বিভিন্ন প্রকৃতির হবে।
উদাহরণস্বরূপঃ- কোন এক শক্তিধর ব্যক্তি আরেক দূর্বল ব্যাক্তিকে অন্যায়ভাবে সবার সম্মুখে প্রহার করল। পৃথিবীর আইনে ১ম ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলায় বিচারকসাহেব অর্থদন্ড বা খুববেশী হলে অর্থদন্ডসহ স্বল্পমেয়াদী কারাদন্ড দিল। কৃত অপরাধীর বিচার যদি পৃথিবীতে হয়ই তবে এর বেশী কিছু বিচারক করতে পারেবনা কারণ সে ক্ষমতা ঐ বিচারকের নাই। পাঠক, ভেবে দেখুন, এটা কি প্রকৃত ন্যায় বিচার হল?
প্রকৃত ন্যায়বিচার সেটাই, যে প্রেক্ষাপটে দুর্বল ব্যাক্তিটা সবার সম্মুখে অন্যায়ভাবে মার খেল, সামাজিকভাবে সবার সম্মুখে অপমানিত হল তার বদলা একইভাবে নিতে পারা। এরূপ বিচারকার্য পৃথিবীতে পুনরানুষ্ঠান করা খুব দুঃসাধ্য ব্যপার। কারণ এর জন্য বিচারকের অসীম ক্ষমতা, অঢেল সময় প্রয়োজন ও সকলকে একই সময়ে একত্রিত করা অসম্ভব। কিন্তু প্রতিপালকের কাছে পরকালে এটা কোন কঠিন কাজই নয়। তখন ঐ মজলুম ব্যক্তিকে ঐ অত্যাচারীর সামনে হাজির করা হবে, আরও হাজির করা হবে ঐ প্রেক্ষাপট ও পরিবেশ এবং উপস্থিত ঐ মানুষগুলোকেও যাদের সামনে মজলুম ব্যক্তিটি প্রহৃত হয়েছিল। এরপর মজলুম ব্যক্তিটি ঐ অত্যাচারিকে একইভাবে তার বদলা নেওয়ার জন্য প্রহার করবে এবং তার অপমানের প্রতিশোধ নিবে। এটার নামই প্রকৃত ন্যায়বিচার।
অনুরূপভাবে অন্যান্য সকল ন্যায়বিচার করবেন বলেই পরকালের বিচারকার্যে এত বেশী সময় লাগবে এবং বিচারপ্রর্থীরা একপর্যায়ে অধৈর্য্য হয়ে উঠবে (হাদীস; সহীহ আল বোখারী)। আল্লাহ’তায়ালার পক্ষে কোটি কোটি মানুষের বেহেশত ও দোযখ নির্ধারণ করার ফায়সালার বিচার করা এক মূহুর্তের ব্যপার মাত্র। একটিমাত্র পরশ পাথর প্রত্যেকের শরীরস্থ রুহের উপর ঠেকালেইতো দুভাগে ভাগ করা কোন ব্যপারই না। না, আল্লাহ’তায়ালা এরূপভাবে বিচার করবেন না। তিনি প্রত্যেকের তার কৃতকর্মের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব নিবেন এবং তার কাছে প্রতিভাত ও সুস্পষ্ট করে দিবেন কোথায় কি ধরণের অন্যায়গুলো সে করেছিল প্রকাশ্যে এবং অপ্রকাশ্যে। অপরাধী নিজে তখন অপরাধ স্বীকার করবে এবং কৃতকর্মের জন্য আফসোস করবে কিন্তু পরিত্রান পাবে না, অপরাধের শাস্তি তাকে পেতেই হবে (সূরা আম্বিয়া; আয়াত ৪৭, সূরা যিলযাল; আয়াত ৭, ৮ এবং সূরা নাবা; আয়াত ৪০)।
অপরপক্ষে পুণ্যবানদের জন্য সুসংবাদ। তার পুণ্য কর্মের একটি শ্রেনীবিন্যাস করা হবে এবং পুণ্যাত্মারা বুঝতে পারবে সে কোন বেহেশতের জন্য উপযুক্ত। এজন্য তার মনে কোন ক্ষোভ থাকবেনা। কারণ এটাই তার ন্যায্য প্রাপ্তি ও পাওনা।
ইসলাম ও পাশ্চাত্য পন্ডিত
বিখ্যাত পন্ডিত বিজ্ঞানী ডাঃ মরিস বুকাইলি তার গ্রন্থসমূহে আল-কুরআনকে ঐশীবানী হিসাবে প্রমাণ করতে পেরেছেন এবং ফলে আধুনিক শিক্ষিত তরুণ সমাজ ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ইসলামকে জানার ও বুঝার চেষ্টা করছে। আল্লাহ তাকে তার যথাযথ প্রতিফল দান করুন। আমার জানামতে তিনি পরে ইসলাম ধর্ম কবুলও করেছেন। আল্লাহ তাকে কবুল করুন।
তার লিখিত বইসমূহে পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান ও রসায়নবিজ্ঞান আলোচনা করে তিনি আল-কুরআনের বাণীকে ঐশীবাণী প্রমাণ করেছেন। তবে ইসলামে স্রষ্টা ও সৃষ্টির সম্পর্ক, রূহ ও রূহের জগত, অবস্থান, চলাফেরা, ফেরেশতা, স্রষ্টার ইবাদত, আত্মার পবিত্রতা, আত্মার পরিশুদ্ধিলাভের উপায়, পরকালীনমূখী মুসলিম মনমনন, আধ্যাত্বিক দর্শন, স্রষ্টার দীদারলাভ তার পুস্তকের বিষয়বস্তু ছিলনা বিধায় তিনি এইসব ব্যপারে আলোকপাত করেননি। তার আলোচনা জীবন ও রূহ একই বস্তু বলে প্রতিভাত হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে জীবন হচ্ছে ‘জীবাত্মা’ ও রূহ হচ্ছে ‘মানবাত্মা’ বা ‘পরমাত্মা’।
ঈমাম গাজ্জালী (রহঃ) তার পুস্তকে (কিমিয়ায়ে শাহাদাত) লিখেছেন আদম (আঃ) কে সৃষ্টির পর আল্লাহতায়ালা তাকে প্রথমে সুগঠিত করেছেন। অর্থাৎ অন্যান্য জীবকে প্রথম সৃষ্টির পর আল্লাহ যে জীবনিশক্তি দিয়ে জীবনদান করেছেন তদ্রুপ হযরত আদম (আঃ) কে জীবনদান করার পর নিজের রূহ থেকে ফুৎকার দিয়ে তাকে আল্লাহ’তায়ালা রূহাত্মা, পরমাত্মা ও মানবাত্মা দান করেছেন এবং সৃষ্টির সেরা তাঁর পৃথিবীতে মনোনীত প্রতিনিধি হিসেবে প্রস্তুত করেছেন (সূরা সোয়াদ; আয়াত ৭১-৭২)।
মানুষ ও বিশ্বপ্রকৃতি
অন্যান্য সৃষ্ট জীবদের জীবনীশক্তি দান করার পর স্রষ্টা একটা নির্দিৃষ্ট নিয়ম বেঁধে ছেড়ে দিয়েছেন (instinct) যা অনুসরণ করে ঐ নিয়মের মধ্যে তারা চলতে থাকে (বিজ্ঞানীরা একে বলে থাকেন প্রকৃতি)। যত বিবর্তন ও বিকাশ এই পরিমন্ডলের মধ্যে অব্যাহতভাবে চলতে থাকে।
পৃথিবীর উদ্ভীদকুল, প্রানীকুল ও সকল মাখলুকাত আলো-বাতাস, গ্রহ-তারা, প্রাকৃতিক পরিবেশ আল্লাহর নির্ধারিত চক্রের মধ্যে সারাজীবন আবর্তিত হতে থাকে। ঋতুচক্র, নাইট্রোজেন চক্র, কার্বনচক্র, প্রাকৃতিক জোয়ার-ভাটা, উল্কাপাত, ঝড়, জলোচ্ছাস, ভূমিকম্প, বৃষ্টিপাত কোন কিছুর উপরই আমাদের নিয়ন্ত্রণ নাই। আমরা দূর্যোগ মোকাবেলা করতে পারি, দূর্যোগের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সীমিত করার চেষ্টা করতে পারি কিন্তু ঐ দূর্যোগ এত বিজ্ঞানের উন্নতির পরেও ন্যূনতম পর্যায়েও প্রতিহত করতে পারি না। যদিও দূর্যোগের পূর্বাভাস, আবহাওয়া, বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা কেমন হবে তা আমরা অনেক নিখুঁতভাবে জানতে পারি (সূরা বাকারা; আয়াত ১৬৪)।
এতে একটা কথা পরিষ্কার যে, প্রকৃতির অনেক জ্ঞানলাভ করে থাকলেও প্রকৃতির কোন লীলাখেলা অর্থাৎ স্রষ্টার নির্ধারিত কার্যধারা ও ফায়সালা থেকে কেহ মুক্ত থাকতে পারছে না।
আজ আমাদের বিজ্ঞানীরা ডিএনএ উৎপাদন করতে পারছেন এবং ঐ ডিএনএ-র অংশকে আরেকটি জীবন্ত জীবকোষের (ই-কোলী) ডিএনএ-র সাথে যুক্ত করে প্রস্তুতকৃত ডিএনএ-র ডিক্টেশন অনুসারে জীবকোষটির বৃদ্ধি সাধনের সাথে সাথে ইস্পিত হরমোন, এনজাইম উৎপাদন করতে পারছেন। একে বলা হয় Recombinant DNA technology। একটা জীবকোষ নিয়ে কালচার করে ঐ জীবকোষের বৃদ্ধি ঘটিয়ে স্ত্রী প্রজাতির জরায়ুতে প্রবেশ করিয়ে পূর্নাঙ্গ প্রানী উৎপাদন সম্ভব করছে আজকের বিজ্ঞান (In vitro fertilization)।
কিন্তু বিষ্ময়ের ব্যপার এই যে, কোষের সকল উপাদান (জৈব ও অজৈব) আলাদা আলাদাভাবে তৈরী ও একত্র করে একটা জীবন্ত কোষ সৃষ্টি করতে পারছেন না। অর্থাৎ anatomical structure তৈরী করা পরও জীবনিশক্তি তাতে সঞ্চারিত হচ্ছে না বা কেও সঞ্চারিত করে দিতে পারছে না। এখন পর্যন্ত অত্যাধুনিক জীববিজ্ঞানে ব্যর্থতা এখানেই।
প্রকৃতিঃ জড় ও জীব
কাজেই স্রষ্টা যে ফুৎকার বা জীবনী শক্তির সঞ্চার করে living being সৃষ্টি করেছেন সেই গতিময়তায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, প্রজাতি থেকে প্রজাতিতে সঞ্চালিত হয়ে চলেছে। তা sexual, asexual যে কোন reproduction হোক না কেন। মানুষের ক্ষেত্রে ১ম মানব হযরত আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়ার (আঃ) যথাক্রমে শুক্রাণু ও ডিম্বাণু থেকে তাদের সন্তানাদি সৃষ্টি হয়েছে, যেখান থেকে হাজার হাজার বছর পরে বর্তমান মানবজাতির আবির্ভাব। কাজেই যে কর্দম থেকে তৈরি ও জীবনীশক্তি সঞ্চার করে আল্লাহ’তায়ালা ছেড়ে দিলেন নতুন করে প্রতিটি মানবে জীবনীশক্তি সঞ্চারের প্রয়োজন হয় না। সেই শক্তি সৃষ্টির শুরু হতে আজ অবধি প্রবাহমান আছে (সূরা হজ্জ; আয়াত ০৫)। মানুষ ছাড়া অন্যান্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে একই জিনিস প্রযোজ্য। জীবজন্তু, গাছপালা, কীটপতঙ্গ ইত্যাদি সবই একই ধারায় চলছে।
Non living object এর ক্ষেত্রে জীবনীশক্তির সংযোগ না হোক কিন্তু ক্ষয়-লয় ও স্বাভাবিক ধ্বংসপ্রাপ্তির প্রক্রিয়া বিদ্যমান যেমনভাবে প্রতিটি জীবনের শেষ পরিনতি আছে ঠিক তেমনিভাবে। তবে জীবের ক্ষেত্রে বংশরক্ষার জন্য জৈবিক প্রক্রিয়ায় মৃত্যুর পূর্বে offspring এর জন্ম হয়ে থাকে যাতে নতুন জীবনীশক্তি সম্পন্ন অনুরূপ প্রজন্মের সৃষ্টি হয়। এটাই স্রষ্টার সৃষ্টি লীলা।
মানুষ সৃষ্টিঃ খলীফা
তবে মানুষ সৃষ্টির ব্যপারটা একটু ভিন্নতর। সৃষ্টিলোকের সমস্ত সৃষ্টির পর আল্লাহ নিজ প্রতিনিধির মর্যাদা দিয়ে সৃষ্টি করে মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন যেন সৃষ্টিকূলের সকল বস্তুনিচয়ের (জীব ও জড়) উপর তার প্রাধান্য ও কর্তৃত্ব বজায় রেখে সকলকে অধীন করে কাজে লাগিয়ে সে চলতে পারে (সূরা আনয়াম; আয়াত ১৬৫)। তবে সেটা উদ্দেশ্যবিহীন নয়। সেরা সৃষ্টি স্রষ্টাকে চিনে তার শুকরিয়া জ্ঞাপন করে তাকে না দেখেও তার প্রত্যাদেশ (যা নবী-রাসূল কর্তৃক প্রচারিত) থেকে বিশ্বাসী হয়ে তাঁর নির্দেশমাফিক ইবাদত করছে কিনা সেটা তিনি দেখতে চান (সূরা মূল্ক; আয়াত ০২)। তিনি দেখতে চান মানুষের জাগতিক ইন্দ্রীয়যুক্ত শরীরের মধ্যেও সুন্দর, স্নিগ্ধ, ভাল, নিষ্কলুষ একটা আত্মা যা স্রষ্টার সোজা পথের অনুসারী, যা স্রষ্টার রঙে রঞ্জিত অর্থাৎ স্রষ্টা সৃষ্টিকে যেরূপ ভালবাসে সেও সেরূপ ভালবাসবে, যা অপছন্দ করেন সেরূপ সেও করবে।
স্রষ্টার সৃষ্টিকে সঠিকভাবে চিনতে ও স্রষ্টার সুক্ষ্ম কারুকার্জ উপলব্ধি করতে পারলেই সে ব্যক্তি স্রষ্টার শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ব উপলব্ধি করতে পারবে এবং রাসূলের প্রদর্শিত সোজা পথে চলতে শুরু করবে। তাকে আর কেও টলাতে পারবে না।
আল্লাহর উপস্থিতি সর্বত্র
প্রত্যেক মানুষের মাঝেই এবং প্রত্যেক ব্যক্তির বাসস্থানেই এবং সকল জায়গার কোন কিছুই আল্লাহর নজরের বাইরে নয়। কোন কিছুরই তিনি বেখবর নন।
তাঁর অস্তিত্ব যেন একটা প্রজ্জলিত প্রদীপ যা স্বচ্ছ কাঁচের আবরনী দ্বারা আবৃত যা থেকে উজ্জল আলোর বিকিরিত হচ্ছে। যদি কেও বাতিকে নিজ বাটিতে না জ্বালাতে চায় তবে সে স্বেচ্ছায় অন্ধকারের মধ্যে নিপতিত হবে যা তার জন্য কখনও মঙ্গলজনক নয়। ঐ বাতিকে প্রজ্জলিত রাখতে কিছু প্রচেষ্টা থাকতে হবে। যথা- উত্তম, সুন্দর তৈলের প্রয়োজন হয় ঐ বাতি জ্যৈাতি ও তৈল সবই খুবই বরকতময় যা পরিবেশকে এক ঐশ্বরিক মহিমায় মহিমান্বিত করবে। পক্ষান্তরে অযতেœ তা হয়ে উঠবে অনুজ্জল, ফলে সকল বরকত ও রহমত তিরোহিত হবে। এতে আল্লাহতায়ালার কোন ক্ষতি হবে না (সূরা নূর; আয়াত ৩৫)।
ইসলামের শরীয়ত (আকায়ইদ শাস্ত্র), তরীকত (আত্মিক পরিশুদ্ধিলাভের পন্থা), হাকীকত (তত্বজ্ঞানের উপলব্ধি), মারেফাত (পরোক্ষ স্রষ্টা দর্শন বা স্রষ্টার অনুভূতি দর্শন বা স্রষ্টার সিফাত ও গুণসমূহের সম্যক প্রত্যক্ষ উপলব্ধি) সম্পর্কে কিছু ধারণা ও বিশ্বাস থাকা একজন মুসলিমের জন্য জরুরী।
ইসলামে আধ্যাত্ববাদ
প্রকৃতিবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, পদার্থ ও রসায়ন বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার যুগে ঐশীগ্রন্থ আল-কুরআন সম্পর্কে এবং স্রষ্টার অস্তিত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের লেখায় যা তত্ত্ব-উপাত্ত পাওয়া যায় তা একজন জ্ঞানপিপাসু যুক্তিবাদী বিশ্বাসীর ঈমানকে আরো সুদৃঢ় করে সন্দেহ নাই। কিন্তু ইসলামের আকীদা বিশ্বাস আমল এইপথ ধরে আবির্ভূত হয়নি।
স্রষ্টার প্রতি দৃঢ় ঈমান একটা অপরিহার্য শর্ত হলেও ঈমানদারকে ঈমানের উৎসমূল আল্লাহর প্রেরিত নবী-রাসূলগনের প্রত্যাদেশ বা ওহীসমূহ। এখান থেকেই একজন মুমীনের জীবনের শুরু যা সে বিশ্বাস করে বা ধারন করে।
মুমীন ব্যক্তি আল্লাহকে বিশ্বাসের পর তার জীবনের গতিপথ এলোমেলো থাকতে পারবে না। একটা নির্দিৃষ্ট বিধি-বিধানের মধ্যে তাকে চলতে হবে এবং ঐ স্রষ্টার নির্দেশমাফিক ব্যক্তিগত পরিশুদ্ধির জন্য ইবাদতে সামিল থাকতে হবে। এই দৈনন্দিন চলার পথের আদেশ নিষেধ ও ইবাদতের বিধি-বিধানের সমন্বিত রূপকে আমরা বলে থাকি ‘শরীয়ত’। যা একজন মুসলিম হিসেবে মেনে চলা অপরিহার্য। ত্রুটি বিচ্যুতির জন্য ইহলৌকিক কর্মফল পেলেও আল্লাহ্ মাফ না করলে পরকালীন শাস্তিও এজন্য তাকে পেতে হবে।
স্রষ্টা ও মানুষ
কিন্তু স্রষ্টা এ সৃষ্টির মধ্যে এরূপ প্রভুভৃত্যের সম্পর্ক নিয়ে বান্দাহর মনে তৃপ্তি আসে না। কারন আল্লাহ তো এই বান্দাহকে নিজ খলীফারূপে সৃষ্টি করেছেন। খলীফা বা প্রতিনিধি ভৃত্যের চাইতে একটু উপরে অবস্থান করে এবং মালিকের ইবাদত করলেও তার সাথে একটা আন্তরিক আকর্ষনের ও ভালবাসার সম্পর্ক বজায় রাখে। তদুপরি আল্লাহর নূর থেকে পৃথিবী সৃষ্টি হলেও মানুষ আল্লাহর রূহের ফুৎকার থেকে বিশেষভাবে সৃষ্টি বিশেষ মর্যাদা দিয়ে সকল মাখলুকাত, জ্বীন, ফেরেশতাদের উপরে মর্যাদা দিয়ে সৃষ্ট। কাজেই এই মানুষ স্বভাবতই তার স্রষ্টার ভালবাসা পেতে চাই যে তাকে এত মর্যাদাশীল করেছে। কাজেই এই মহান স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভের উপায় কি তা মানুষ তালাশ করে।
বলাবাহুল্য যে, আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে আল্লাহর নূরের অনুরূপভাবে প্রজ্জলিত করতে পারলে তবে স্রষ্টার ভালবাসা লাভ করা যাবে। এক্ষেত্রে তাঁর কর্তৃক নিষিদ্ধ সকল জিনিস পরিহার করে ও তাঁর নির্দেশিত সকল জিনিসকে সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করতে হবে এবং গ্রহণের এই পন্থার নাম ‘তরীকত’।
আধ্যাত্মিক শিক্ষক
অনেকে মনে করেন এব্যপারে একজন শিক্ষকের প্রয়োজন। কারণ, সরাসরি দ্বীনের খুঁটিনাটি ও মহত্ব বুঝা খুবই কঠিন ব্যপার। এ কথাটি খুবই সত্য। কারণ, নিজে বই পড়ে সবাই একইরকম জ্ঞানলাভ করতে পারে না। সবার মেধাশক্তি এক নয়। আবার বই কোথায় পাওয়া যাবে? বই নিজে একজন শিক্ষকের ভূমিকা পালন করে। এক্ষেত্রে বই লেখক হচ্ছে একজন শিক্ষক যিনি পরোক্ষ উপায়ে শিক্ষাদান করছেন। তিনি নিশ্চয় ঐ বই লেখার জন্য আরো অনেক জ্ঞানী-গুনীর বানী এবং লেখা পুস্তকের সাহায্য নিয়েছেন। তার পূর্বের জন এরূপভাবে তার পূর্বজনের নিকট থেকে জ্ঞানলাভ করেছেন। এভাবে যদি আমরা পেছনের দিকে অনুসন্ধান শুরু করি তবে তা যেয়ে ঠেকবে মুসলিমদের ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়তের জ্ঞানের উৎস অর্থাৎ সেগুলো হচ্ছে আল-কোরআন (আল্লাহর প্রত্যাদেশ), হাদীস (নবীজীর আদেশ ও বাস্তব জীবনে প্রদর্শিত নিয়ম-কানুন), ইজমা (ফেকাহ শাস্ত্রবিদদের সম্মিলিত মতামত), কিয়াস (পূর্বের তিনটির বাইরে কোন ইসলামী গবেষকের গবেষনালব্ধ মতামত)।
আমরা যদি আরো পেছনে যেতে শুরু করি এবং শিক্ষার উৎস তালাশ করি তবে তা গিয়ে দাঁড়াবে খোদ আল্লাহ’তায়ালার হযরত আদম (আঃ) -কে শিখিয়ে দেওয়া জ্ঞান পর্যন্ত। উল্লেখ্য যে এক্ষেত্রে জ্ঞান বলতে স্রষ্টাকে চেনা ও তাঁর ভালবাসা পাওয়ার জ্ঞানকে বুঝানো হচ্ছে। প্রকৃতিলব্ধ তত্ত্বজ্ঞান ও মানুষের অভিজ্ঞতাকে বুঝানো হচ্ছে না। স্রষ্টাকে চেনার জ্ঞানের পাশাপাশি এই জ্ঞান মানুষ যুগ যুগ ধরে অর্জন করছে এবং তা পরিসরে দিনে দিনে বৃদ্ধি পেয়ে যাচ্ছে।
পীর ও মুরীদ
বইপত্রের বাইরে শিক্ষকেরও একান্ত প্রয়োজন। আমাদের সমাজের এরূপ আধ্যাত্বিক শিক্ষকগন ‘পীর’ নামে অভিহিত এবং শিক্ষার্থীগন ‘মুরীদ’ নামে।
পীরদের কাজ হচ্ছে মুরীদকে সঠিক শরীয়ত তথা (আকায়ইদশাস্ত্রের) জ্ঞানদান, সে অনুসারে আমল করার প্রত্যক্ষ শিক্ষাদান করে তার আধ্যাত্বিক চাহিদাপূরন করে তার আত্মিক পরিশুদ্ধি এমনভাবে ঘটানো যেন সে স্রষ্টার যাবতীয় সৃষ্টিলীলার তত্বজ্ঞান উপলব্ধি করে নিজের আত্মাকে স্রষ্টার প্রতি আরও আকৃষ্ট ও প্রেমাবিষ্ট করতে পারে।
সফল শিক্ষক
প্রকৃত সফল শিক্ষক হল সেই যে তার শিষ্যকে এমনভাবে তৈরী করবে যে শিষ্য শিক্ষকের মত কিংবা তার চেয়েও উচ্চস্থানে আসীন হতে পারে এবং শিক্ষক ছাড়া নিজেও চলতে পারে এবং নিজেও একজন কৃতিসম্পন্ন শিক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। ব্যর্থ শিক্ষক সেই জনই যার শিষ্য বা ছাত্ররা জীবনভর শিক্ষক নির্ভর হয় এবং শিক্ষক ছাড়া এক কদমও চলতে পারে না ভবিষ্যতে নিজে সফল শিক্ষক হওয়াতো দূরের কথা। ছাত্রকে সবসময় তার মুখাপেক্ষী করে অথর্ব করে ধরে রেখে নিজের পান্ডিত্যের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করে। এই জিনিসটা theory এবং practice অর্থাৎ জ্ঞান ও আমল উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
ভন্ড শিক্ষক
এই দুধরণের শিক্ষক ছাড়াও এই লাইনে আছে আরও ধূর্ত, অনৈতিক শিক্ষক যারা প্রকারান্তরে শিষ্যের সাথে প্রতারণা করে। বাহ্যিকভাবে কিছু একটা অতিন্দ্রীয়জ্ঞানের অধিকারী বলে প্রচার ও প্রদর্শন করে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষন করতে সক্ষম হয় এবং এদের শিষ্য বানিয়ে ফেলে। অধিকাংশক্ষেত্রেই এই শিষ্যগণ লেখাপড়া ও বিদ্যা বুদ্ধিতে বিশেষত ধর্মীয় জ্ঞানে তথা স্রষ্টাকে চেনার জ্ঞানে খুবই দুর্বল থাকে বিধায় অনেক মূর্খ ও তথাকথিত পন্ডিতমূর্খ ব্যক্তিরাও এদের শিষ্য হয়ে এদের পেছনে অনেক সময় ও অর্থ ব্যয় করে। এবং মনে করে যে আরধ্য জিনিসটা ঐ শিক্ষক আমার জন্য রিজার্ভে রেখে দিবে। দ্বীন ও ধর্মের প্রকৃত সত্য এরকম ঠুনকো হওয়া একেবারেই অসম্ভব।
আমাদের মুসলিম সমাজে প্রকৃতপক্ষে খাঁটি শিক্ষক পাওয়া এবং খুঁজে বের করা দুঃসাধ্য তবে অসম্ভব নয়। আল্লাহ’তায়ালা যাকে পথ দেখাবেন তাকে সেভাবে আধ্যাত্বিক শিক্ষক ও জোগাড় করে দিবেন।
আধ্যাত্বিক জ্ঞানের প্রতিষ্ঠান
আমাদের সমাজে ‘তাসাউফ’ জ্ঞানচর্চার যদি কোন religious institution থাকতো তবে সেখানে কিছু কিছু প্রকৃত শিক্ষক পাওয়া যেত কিংবা তৈরী হত। কিন্তু বাস্তবে সেরূপ নেই।
আমাদের সমস্যা হচ্ছে কাউকে শিক্ষক মেনে নিয়ে তার পেছনে বেশ কয়েকবৎসর সময় ব্যয় করে তার বিপথগামীতা বুঝতে পেরে ফিরে এসে নতুন পথে চলাটা খুবই কষ্টকর। এভাবে ধাক্কা খেতে খেতে মানুষের এই সংক্ষিপ্ত জীবনে কতদূর আর অগ্রসর হতে পারবে? কাজেই এখানেই বিপদ।
ব্যক্তিগত অধ্যয়ন, তত্বজ্ঞান, বিদ্যাবুদ্ধী দিয়ে স্রষ্টাকে চেনা ও তার পথে শরীয়ত, তরীকত পর্যন্ত চলা যায় কিন্তু বিশেষ বিশেষ কিছু আমল আকীদা যা নফল হলেও অতীব গুরুত্বপূর্ণ তা একাকী আমল ও রপ্ত করা খুবই কঠিন।
আল্লাহর যিকির ও মারেফাত
আল্লাহর একজন আবেদ বান্দা শুধুমাত্র ফরয, সুন্নত ইবাদত পালন করেই নিজের তৃপ্তি মেটাতে পারে না। তাঁর সান্নিধ্য লাভের আশায় ঐসবের পাশাপাশি অতিরিক্ত বা নফল ইবাদত স্রষ্টার উদ্দেশ্যে তাৎপর্যপূর্ণভাবে করে এবং তাঁর নূরের সন্ধানে ব্যাপৃত থাকে। সেক্ষেত্রে সমাজ ও সংসারকে সে তুচ্ছজ্ঞান করে। সদাসর্বদা স্রষ্টার ভালবাসায় বিভোর হয়ে থাকে। এরই নাম প্রকৃত যিকির বা কল্বজারী। যিকিরকারীর সমস্ত শরীর ও আত্মা জুড়ে স্রষ্টার সর্বদা গুণকীর্তন চলতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে এটা হচ্ছে স্রষ্টার অস্তিত্বের সাথে আত্মিকভাবে নিজকে বিলীন করে দেওয়া (সহীহ বুখারী, কিতাবুর রিফাক, হাদীস নং-৬৫০২- পৃষ্টা নং-১৪ দ্রষ্টব্য)।
এমতাবস্থায় তার প্রতিটি কর্মকান্ড স্বাভাবিকভাবে স্রষ্টার নির্দেশিত কর্মকান্ড থেকে আলাদা হবে না এবং সকলপ্রকার চিন্তা চেতনা ও ধ্যান ধারনা স্রষ্টার থেকে পৃথক হবে না। এরূপ মানুষ আল্লাহর প্রেমে এমনই ‘মজনুন’ থাকে যে স্রষ্টার সাথে মিলিত হওয়ার আশায় পৃথিবীর অস্তিত্বকে সে অস্বীকার করে বাস্তবতার বাইরে অনেকসময় চলে যায়। এরূপ ব্যক্তির রূহ্ ও আল্লাহর নূরের মাঝে একটা পর্দা থাকে মাত্র (ঈমাম গাজ্জালীর কিমিয়ায়ে শাহাদত পুস্তক, পৃঃ ৯৯১)। এই অবস্থানকে বলা হয় মারেফাত বা স্রষ্টা দর্শন। নামাজে দাঁড়িয়ে এরূপ মারেফাত অর্জনকারী ব্যক্তি তার অন্তরদৃষ্টিতে স্রষ্টাকে দেখতে পায়।
হযরত আলী (রাঃ) নামাজে এমনই গভীর মগ্ন হয়ে যেতেন যে স্রষ্টার অনুভূতি ছাড়া আর কোন অনুভূতি তার থাকতো না। শরীর সকল প্রকার ইন্দ্রীয়ানুভূতির অতীতে তিনি চলে যেতেন। এমন আবিষ্টভাবে নামায আদায় বা ইবাদত আর পৃথিবীর কোন ব্যক্তির ক্ষেত্রে আছে বলে আমার জানা নেই। গভীর মগ্নতায় থাকলে কেউ ডাকলে বা স্পর্শ করলে তা বুঝতে না পারার ঘটনা বিরল নয় কিন্তু কেউ আঘাত করলে বা ব্যাথা দিলে একমাত্র deep coma-তে থাকা রুগীরা অজ্ঞান অবস্থায় টের পায় না। এছাড়া সবাই ব্যাথানুভূতি টের পায় এবং সাড়া (response) দেয়। কিন্তু নামাজের মধ্যে হযরত আলী (রাঃ) কোন জগতে চলে যেতেন যে ইহজগতের সকল অনুভূতি এমনকি ব্যাথার অনুভূতিতেও কোন সাড়া পাওয়া যেত না।
একবার এক যুদ্ধে হযরত আলী (রাঃ) পায়ে একটা তীরখন্ড বিঁধে যায় সেটা বের করতে চেষ্টা করলে তিনি এতটাই ব্যথা পেতেন যে সেটা বের করতে দিতেন না। সাহাবায়েকেরামেরা চিন্তিত হয়ে গেলেন। এই বস্তুটি আটকে থাকার পরিনতি ঐস্থানে প্রদাহ, পচন ও সর্বনাশ হওয়া তা তারা জানতেন। তাই সবাই নবীকরীম (সাঃ) এর দরবারে হাজির হলেন এবং ব্যপারটির সুরাহা চাইলেন। একটু চিন্তা করে নবীকরীম (সাঃ) বললেন “হযরত আলী নামাযরত অবস্থায় ঐ তীরটি উঠিয়ে ফেলো”। হলোও তাই। নামাযরত অবস্থায় তীর উঠানো হল। তিনি টেরও পেলেন না। এমনকি একটা শব্দও করলেন না। এরূপ ছিল তার নামায। এরূপ ছিল তার আধ্যাত্বিক দর্শন, মারেফাত বা স্রষ্টা দর্শন।
স্রষ্টা দর্শন
একথা ঠিক যে আল্লাহতায়ালার নূরের তাজাল্লী কেউ এই পৃথিবীতে সহ্য করতে পারবেনা। বেহেশতী বান্দারা পরকালে সেটা পারবে। কাজেই প্রকৃত আল্লাহর স্বরূপ দর্শন যেটা মূসা (আঃ) নবী হয়েও দেখতে চেয়েও পারেননি (সূরা আল আরাফ; আয়াত ১৪৩)। সেটা একজন মানুষ তা তিনি যে স্তরের দ্বীনদ্বার বা কামেল হউন না কোন সচক্ষে দেখার প্রশ্নই আসে না।
তবে তাঁর অস্তিত্ব অনুভব করা যায়। নিজের অস্তিত্বকে তাঁর মধ্যে বিলীন হওয়ার মত আধ্যাত্বিক একটা পর্যায়ে উপনীত হওয়া সম্ভব। এমতাবস্থায় স্রষ্টার ইচ্ছায় তার ইচ্ছা, স্রষ্টার অনিচ্ছা তার অনিচ্ছায় পরিণত হয়। এমতাবস্থায় এরূপ কামেল ব্যক্তিকে বাহ্যজ্ঞান লোপসম্পন্ন মনে হতে পারে আমাদের স্থুলজ্ঞানে। কারণ আমরা ধার্মিক হলেও মনমস্তিষ্ক, বস্তুর প্রতি, ভোগের প্রতি তথা দুনিয়ার সুখের প্রতি আমাদের একটা টান থাকে যেটা ঐ ব্যক্তির থাকে না বলে আমরা তার দৃষ্টিকোন থেকে তাকে বুঝতে পারি না। বুঝার চেষ্টা করি আমাদের দৃষ্টিকোন থেকে।
প্রকৃত সুফী
তাই বলে এরূপ ব্যক্তি এমন পাগল নয় যার চিন্তাজগৎ এলোমেলো ও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বরং ঐব্যক্তি এমন ভাল দ্বীনি শিক্ষক যিনি জ্ঞান ও আমলের এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছেন যে তার সান্নিধ্যলাভে অন্যেরাও সেইপথে অগ্রসর হতে পারে। তিনিও নির্দ্বিধায় তার এরূপ অনুসারীকে বিনা পারিশ্রমিকে আধ্যাত্বিক সাধনার পথে এগিয়ে নিয়ে চলবেন। তার অনুসারী বা ভক্ত বা মুরীদের তার প্রতি দুর্বলতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি বৈষয়িক কোন কিছু অর্জন করবেন না।
প্রকৃতপক্ষে এরূপ দ্বীনদ্বার নেতা, শিক্ষক, পীর ও ঈমাম আমাদের সমাজে পাওয়া দুষ্কর। আমাদের চেষ্টা থাকতে হবে এবং আল্লাহ’তায়ালা তাদের মিলিয়েও দিতে পারেন। মন আন্তরিকভাবে যেটা চায় আল্লাহ’তায়ালা অনেকসময় তা মিলিয়েও দেন।
বাস্তবিকপক্ষে এরূপ ব্যক্তি একজন সাধক এবং সাধক প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানের অধিকারীও হতে পারেন। তবে প্রতিষ্ঠান কখনও সাধক বানিয়ে দিতে পারে না। জীবনভর সাধনা করে একজন সিদ্ধিলাভ করে।
আধ্যাত্বিক নেতৃত্ব ও সামাজিক নেতৃত্ব
অনেকের ধারণা এরূপ কামেল সাধক সমাজ সচেতন ব্যক্তি নন। নিজে শুধু স্রষ্টার ধ্যানে মগ্ন থাকেন। পৃথিবীর কোন কিছু খেয়াল করেন না। কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। একথা ঠিক যে পার্থিব জিনিস তথা পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র নিয়ে বেশী সময় মাথা ঘামালে স্রষ্টার ধ্যান করার সময়ে অপ্রতুলতা দেখা দিবে। কাজেই তারা এব্যপারগুলোতে সময় কম দিতে চান। সমস্যাগুলো অন্যদের মাধ্যমে সমাধা করতে আগ্রহী হন কিংবা স্রষ্টার ফায়সালার অপেক্ষায় নির্লিপ্ত থাকেন। তবে প্রয়োজনে তারা ‘মোরাকাবা’ (আধ্যাত্বিক ধ্যান), ‘ইস্তেখারা’ (দোয়ার মাধ্যমে কোন বিষয়ের কল্যান চাওয়া) ইত্যাদির মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চেষ্টা করেন, নির্লিপ্ত থাকেন না। কাজেই এরূপ ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করার অযোগ্য এমন নয়।
উপসংহার
প্রকৃত শিক্ষকের সন্ধান পাওয়া সে যে শিক্ষকই হোক না কেন তা খুবই দুরূহ ব্যপার। আধ্যাত্বিক শিক্ষকের ক্ষেত্রে এই কথাতো বলাই বাহুল্য। বিশেষতঃ ছাত্র যদি শিক্ষক নির্বাচন করতে চায় তার সীমিত জ্ঞানের মাধ্যমে তবে সেটা প্রায়ই ভুল নির্বাচন হবে। বরং প্রতিষ্ঠান বা শিক্ষক বলতে পারে ঐ ছাত্রের কোন, কেমন শিক্ষক দরকার।
আধ্যাত্বিক প্রতিষ্ঠানের এরূপ ধারাবাহিকতা পূর্বে নবী, সাহাবা, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন এবং পরবর্তীতে তাদের অনুসারীদের মধ্যে ছিল যা আজ আর নাই। এখন যা আছে বিক্ষিপ্ত যা অনেকক্ষেত্রে ছাত্রের ধোঁকায় পড়ার কারণ হতে পারে। তবুও আধ্যাত্বিক জ্ঞানপিপাসু মানুষ সঠিক শিক্ষকের সন্ধান পেয়ে তাদের আরধ্য মারেফাত হাসিল করুক এই কামনা করে শেষ করছি। আমীন।।।
আমার নৈকট্য অর্জন ও ওলী হওয়ার জন্য বান্দা যত কাজ করে তন্মধ্যে সবচাইতে আমি ভালবাসি যে কাজ আমি ফরয করেছি। এরপর বান্দা যখন সর্বদা নফল ইবাদত পালনের মাধ্যমে আমার নৈকট্যের পথে অগ্রসর হতে থাকে তখন আমি তাকে ভালবাসি। আর যখন আমি তাকে ভালবাসি তখন আমি তার শ্রবণযন্ত্রে পরিণত হই, যা দিয়ে সে শুনতে পায়। আমি তার হাত হয়ে যায়, যা দিয়ে সে ধরে ও আঘাত করে এবং আমি তার পা হয়ে যায় যা দ্বারা সে হাঁটে। সে যদি আমার কাছে কিছু প্রার্থনা করে তাহলে আমি অবশ্যই তাকে প্রদান করি। সে যদি আমার নিকট আশ্রয় চায় তবে আমি তাকে অবশ্যই আশ্রয় প্রদান করি (সহীহ বুখারী, কিতাবুর রিফাক, হাদীস নং-৬৫০২)।